নবীদের নিষ্পাপ হওয়া প্রসঙ্গে মাওলানা মওদূদী(রহ.) এর অবস্থান কি?
মাওলানা মওদূদি কি নবীদের নিষ্পাপ হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে?
নবীদের নিষ্পাপ হওয়া প্রসঙ্গে মাওলানা মওদূদী(রহ.) এর অবস্থান কি?
মাওলানা মওদূদি (রহ.) এর উপর আনিত কিছু মিথ্যা অভিযোগের মধ্যে অন্যতম একটি অভিযোগ, ‘মওদূদি সাহেব নবীদের নিষ্পাপ মনে করেনা।।’
মিথ্যা অভিযোগের জবাব।
মাওলানা মওদূদি (রহ.) তার অনেক লিখাতেই নবীদের সুস্পষ্টভাবে নিষ্পাপ বলেছেন।
দৃষ্টান্ত-১
আল্লাহর রাসুল (সা:) ছাড়া অন্য কাউকে যাচাই-বাছাইয়ের উর্ধ্বে মনে করবে না। [1]সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদি; গঠণতন্ত্র, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী; পৃষ্ঠা নং-১১।
নিষ্পাপ হওয়া ছাড়া কি কেউ যাচাই বাছাইয়ের উর্ধে থাকতে পারে?
দৃষ্টান্ত-২
ত্রুটিহীন ও নিষ্পাপত্ব একমাত্র নবীদের বৈশিষ্ট্য [2]সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদি; রাসায়েল ও মাসায়েল, ৫ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ১৯৮
দৃষ্টান্ত-৩
আমি নবী ছাড়া আর কাউকে ইসলাম মনে করিনা [3]সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদি; রাসায়েল ও মাসায়েল, খন্ড নং-২; পৃষ্ঠা নং-৩৩১
দৃষ্টান্ত-৪
নবীগণের ত্রুটিমুক্ত ও পাপমুক্ত হওয়াটা নি:সন্দেহে একটা মৌলিক বিষয়। [4]সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদি; রাসায়েল ও মাসায়েল; ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ৬১
দৃষ্টান্ত-৫
আম্বিয়া কিরাম ছাড়া অন্য কাউকে আমি নিষ্পাপ মনে করিনা। [5]সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদি; রাসায়েল ও মাসায়েল; ১ম খন্ড; পৃষ্ঠা ২৮৯
দৃষ্টান্ত-৬
কেবল নবী-রাসূলেরাই নিষ্পাপ নিষ্কলুষ।[6]সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদি; খেলাফত ও রাজতন্ত্র; পৃষ্ঠা- ২৯৫
দৃষ্টান্ত-৭
হযরত রাসূল (সা:) কুপ্রবৃত্তী থেকে মুক্ত ছিলেন। তার সবকিছুই গোমরাহী ও প্রবৃত্তির লালসা থেকে মুক্ত ছিলো। আল্লাহ তা’তায়ালা তাকে নিখুত, নির্ভুল এবং সত্যাশ্রয়ী বিবেক ও স্বভাব-প্রকৃতি দিয়ে সৃষ্টি করেছিলেন। [7]সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদি; সীরাতে সরওয়ারে আলম, ১ম খন্ড; পৃষ্ঠা: ২২২-২২৩
এরকম সুস্পষ্ঠ বক্তব্য থাকার পরে যারা মাওলানার উপর এহেন ডাহা মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর অভিযোগ উথাপিত করে কি মওদূদির (রহ;) এর উপর জুলুম করছেনা? তারা কি এসবের জন্য কিয়ামতের মাঠে আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতা দেওয়া লাগবে বলে মনে করেনা? নিসন্দেহে যারা শুধুমাত্র ব্যক্তি স্বার্থে মাওলানা মওদূদির কথা নিজেদের ইচ্ছামতো কাটছিট করে মানুষকে বিভ্রান্ত করে তার জালিমের অন্তভূক্ত।
মাওলানা মওদূদি (রহঃ) তার লিখায় সুস্পষ্টভবে বলেছেন যে নবীগণ হলো নিষ্পাপ। তবে এইকাথাও সত্য যে তিনি বিভিন্ন জায়গায় নবীগনের ভুলত্রুটি নিয়ে আলোচনা করেছেন তার লিখনিতে। যেমন, তাফহীমুল কুরাআনে সূরা নাসরের তাফসীর ( এই বিষয়ে নিন্মে আরো বিস্তারিত আলোচনা থাকবে)। তবে এখানে যে জিনিসটি মাথায় রাখা উচিত এসব লেখায় তিনি কেবল মাত্র কুরআনে বর্ণিত নবীগণের ভুলত্রুটি সম্পর্কে আলোচনা করেছে( যা কবীরা গুণাহ নয় বা অনিচ্ছাকৃত)। এবং এই বিষয়ে একই আলোচনা প্রায় সকল আলেমই করেছেন। নির্দিষ্ট একটা গন্ডির আলোচনাকে সার্বিকভাবে উপস্থাপন করে ওনাকে ইসমতে আম্বিয়া অস্বীকারী হিসেবে উপস্থাপন করা অবশ্যই অবিচারের অংশ। শুধুমাত্র কুরআনের বর্ণিত নবীদের ভুলত্রুটি নিয়ে আলোচনা করার কারণে যদি মাওলানা মওদূদি ইসমতে আম্বিয়া অস্বীকারী হয়ে যায় তাহলে গোটা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের সমস্ত আলেমও ইসমতে আম্বিয়া অস্বীকার হয়ে যায়।
কুরআনে বর্ণিত নবীদের ভুলত্রুটি সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য আলিমদের অভিমত।
ইমাম ফখরুদ্দীন রাযীর মতে,
আম্বিয়া কিরাম নবুওয়্যাত প্রাপ্তির সময় থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে কবীরা গুণাহ ও ছগীরা গুণাহ থেকে পবিত্র। তবে অনিচ্ছাকৃতভাবে কবীরা ও ছগীরা দুটোই হতে পারে। [8]ফখরুদ্দীন রাযী, ইসমতে আম্বিয়া, পৃঃ২৮
ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ) এর মতে,
নবীগণ কবীরা গুণাহ থেকে পবিত্র, ছগীরা গুনাহ থেকে পবিত্র নয়। [9]ইবনু তাইমিয়া, মাজমুউল ফাতাওয়া (৪/৩১৯)
আল্লামা আলুসী (রহ) এর মতে,
তিনি ১২৭০ হি. তার বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ ‘রুহুল মা’আনীতে’ সূরা ‘ত্বহা’ এর তাফসীরে বলেন, অধিকাংশ আলিমদের মতানুসারে নবুওয়্যাত প্রাপ্তির পরও নবীদের থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে ছগীরা গুণাহ হতে পারে। কিন্তু যা ঘৃণিত স্বভাবের পরিচয় বহন করে ওই ধরণের ছগীরা গুনাহ হতে পারেনা। তিনি আরো বলেন, ‘আদম (আঃ) থেকে যা সংঘটিত হয়েছিল তা কবীরা গুনাহ ছিল। [10]শিহাব উদ্দীন আলুসী, রুহুল মা’আনী (৮/৫৮৩)
আল্লামা তাফতাজানী (রহ) এর মতে,
তিনি ৯৩৯ হি. নবীগনের নিষ্পাপ হওয়া প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, নবীগণ মিথ্যা হতে পবিত্র। …….. জমহুর আলিমদের মতে নবীদের ইচ্ছাকৃত ছগীরা গুণাহ হতে পারে। আর অনিচ্ছাকৃতভাবে ছগীরা গুণাহ হওয়ার ব্যাপারে সকলেই একমত। [11]মোল্লা আলী কারী, মিরকাতুল মাফাতীহ, (৫/১৭২০)
ইমাম আবু হানিফা এই বিষয়ে বলেন,
নবীগণ ছগীরা গুনাহ, কবীরা গুণাহ, কুফুর ও অশালীন কর্ম থেকে পবিত্র ও বিমুক্ত ছিলেন। তবে কখনো কখনো পদস্থলন ও ভুলত্রুটি তাঁদের হয়েছে। [12]নুমান বিন সাবিত, আল ফিকহুল আকবার, পৃ. ৩৭। ড. খন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, আল … Continue reading
দেওবন্দের আলেম মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (রহ) এর মতে,
মুফতি শফী মাওলানা থানবীর এর বরাত দিয়ে বলেন, কোনো সময় নবীদের থেকে কোনো ব্যাপারে ভুলত্রুটি হওয়ার যে ঘটনাসমূহ কুরআনের মধ্যে উল্লিখিত হয়েছে এগুলো প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তায়ালার হেকমত ও রহমত। এর মধ্যে এক বড়ো ফয়দা এটাও যে, মানুষের মধ্যে নবীদের খোদা হওয়ার সন্দেহ না হয়। ভুলত্রুটি হওয়া এবং এর ওপর আল্লাহর সতর্ক করা এটাই প্রমাণ করে যে, নবীরাও আল্লাহ এর বান্দা। [13]মুফতী মুহাম্মদ শফী, মাজালিসে হাকিমুল উম্মত. পৃ-৬৫
কওমী আলেম, ইসমাইল হোসেন তার ,“আলোচিত অভিযোগের কাঙ্ক্ষিত জবাব’ শিরোনামে লিখিত বইতে এই বিষয়ে বলেন,
মাওলা মওদূদি এই বিষয়ে ‘ভুলত্রুটি সংঘটিত’ হয়েছে একথা বলেছেন। কিন্তু ইমাম রাযি, ইবনু তাইমিয়া সহ অন্যান্য আলিমগণ ‘গুণাহ’ শব্দ ব্যাবহার করার পরেও তাদের বিপক্ষে কেউ আজ পর্যন্ত ফতোয়া দেয়নি। কেউ তাদের আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত থেকে খারিজ করে দেয়নি। কিন্তু দুখজনক হলেও হলেও সত্য, মাওলানা মওদূদি ‘গুণাহ’ শব্দ ব্যবহার করার কারণে তাকে ফাসিক, কাফির বানিয়ে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত থেকে খারিজ করে দেওয়া হচ্ছে। [14]আসলাম হোসাইন; আলোচিত অভিযোগের কাঙ্ক্ষিত জবাব, পৃষ্ঠা নং- ২৭
বর্তমানে সালাফি মানহাজের বিখ্যাত আলেম, Sheikh Muhammed Salih Al-Munajjid তার বিখ্যাত ওয়েভসাইট islamqa.info তেও এক প্রশ্নের জবাবে একই কথা বলেছেন যে, নবীদের দ্বারা অনিচ্ছাকৃতক ভুলত্রুটি হতে হয়েছে। [15]Did the Prophet (peace and blessings of Allaah be upon him) commit sin? – Islam Question & Answer (islamqa.info)
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতে নির্ভরযোগ্য আলেমদের মতেই নবীদের দ্বারা অনিচ্ছাকৃতভাবে কবীরা গুণাহ হতে পারে। তার সগীরা গুণাহ হওয়ার ব্যাপারে সকলেই একমত।
কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় নবীগণের ভুল ত্রুটি সম্পর্কে বর্ণিত দৃষ্টান্ত।
আমরা ইতিপূর্বে আদমকে নির্দেশ দিয়েছিলাম। অতঃপর সে ভুলে গিয়েছিল এবং আমরা তার মধ্যে দৃঢ়তা পাইনি। (ত্বোয়া-হা ২০/১১৫)
তিনি (আল্লাহ) বললেনঃ হে নূহ! এই ব্যক্তি তোমার পরিবারের অন্তর্ভুক্ত নয়, সে অসৎ কর্মপরায়ণ। অতএব তুমি আমার কাছে এমন বিষয়ের আবেদন করনা যে সম্বন্ধে তোমার জ্ঞান নেই। আমি তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি যে, তুমি অজ্ঞ লোকদের অন্তর্ভুক্ত হয়োনা। (হূদ; ১১/৪৬)
হে নবী! আল্লাহ যা তোমার জন্য হালাল করেছেন তা তুমি কেন হারাম করছ? (এর দ্বারা) তুমি তোমার স্ত্রীদের সন্তুষ্টি পেতে চাও, (আল্লাহ তোমার এ ত্রুটি ক্ষমা করে দিলেন কেননা) আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, বড়ই দয়ালু। (তাহরীম, ৬৬/১)
সূরা নাসরের তাফসীরে মাওলানা মওদূদির ব্যাখ্যা ও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আলেমদের ব্যাখ্যা।
ইতিমধ্যে কুরআন এবং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আলেমদের কথা থেকেই প্রমাণিত হলো যে অনিচ্ছাকৃতভাবে নবীদের ভুলক্রটি হয়। এই ব্যাপারে তেমন দ্বিমত নেই। সুতরাং, তাফহিমুল কুরআনে সূরা নাসরের তাফসীরে উল্লখিত, ‘তোমার রবের কাছে দোয়া করো। তিনি তোমাকে যে কাজ করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন তা করতে গিয়ে তোমার যে ভুলত্রুটি হয়েছে তা যেন তিনি মাফ করে দেন।’ এই অংশের সাথে কুরআন ও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের স্কলারদের ব্যখ্যার সাথে কোনো রকম সাংঘর্ষিকতা নেই। বরং অন্যনা আলেমদের চাইতে মওদূদির শব্দ চয়ন ছিলো সম্মানজনক।
যেমন, মুফতী মুহাম্মদ শফি (রহ) সূরা গাফিরের ৫৫নং আয়াতের তাফসীরে বলেন,‘আর আপনি গুহাণের জন্য ক্ষমা পার্থনা করুন।’
শুধু তাই না, শাইখুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসান দেওবন্দী (রহ) ও গুণাহ শব্দটি ব্যাবহার করেছেন। (তরজমায়ে কুরআন)
মিশরের সাইয়েদ কুতুব তার রচিত তাফসীর তাফসিরে ফি যিলালিল কুরআনেও গুণাহ শব্দটি ব্যাবহার করেছেন। গুনাহ শব্দের চাইতে ভুল ত্রুটি শব্দটা অনেক বেশি সম্মানজনক।
আহলে সুন্নাত ওয়ালা জামায়াতের আলেমগণের মত অনুযায়ী নবীদের অনিচ্ছাকৃত ভুল-ত্রুটি রয়েছে। নবীরা যদি ভুল করেন তাহলে কি রিসালত সম্পর্কে বা নবীদের হুকুম সম্পর্কে আমাদের সন্দেহ সৃষ্টি হওয়ার কথা নয়?
অধিকাংশ ওলামাদের মতে নবীদের থেকে আল্লাহ কিছু সময় হিফাজত উঠিয়ে নিয়েছেন। নবীদের অনিচ্ছাকৃত ভুল আছে। এই কারণে অনেকে একটি প্রশ্ন উথাপিত করেন যে, নবীরা যদি ভুল করেন তাহলে নবীরা কি সত্যের মাপকাঠি থাকেন? যেকোনো হুকুম নিয়েই তো সন্দেহ করা যায়। যেহেতু নবীদের ভুল আছে, আল্লাহ কিছু সময় তাদের উপর থেকে ইসমত উঠিয়ে নিয়েছেন সেহেতু আমরা তো প্রতিটি হুকুম নিয়েই প্রশ্ন তুলতে পারি যে এটি কি ইসমত উঠিয়ে নেওয়ার সময়ের হুকুম নাকি স্বাভাবিক সময়ের হুকুম?
এধরণের প্রশ্ন যে শুধু এখন করা হয়ে থাকে তা নয় দেওবন্দের আলেম মাওলানা হোসাইন আহমেদ (রহ) মাওলানা মওদূদির সমালোচনা করতে গিয়ে তিনার লিখিত ‘মওদূদী দস্তর’ বইতে বলেন,
তাফহীমুল কুরআনে উল্লেখ আছে প্রত্যেক নবী থেকে ইছমত বা হিফাজত উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং ইচ্ছে করে ভুল ক্রটি করানো হয়েছে। এমত অবস্থায় কোন নবীই সত্যের মাপকাঠি হতে পারেনা এবং কোনো নবীর উপর সর্বদা ভরসাও করা যায়না। যে হুকুমই হোক না কেন, এতে এ সন্দেহ থাকবে যে হয়তো এটা ইছমত ও হেফাজত উঠিয়ে নেয়ার সময়ের। এখন বলুন, এ মতভেদ মৌলিক না আংশিক এবং বলুন জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের প্রতিষ্ঠাতা মুসলমান কি না?
মাওলানা বশিরুজ্জামান তার লিখিত ‘সত্যের আলো’ বইতে এই অভিযোগের জবাব দিতে গিয়ে বলেন,
মাদানী (রহ) এর সমালোচনা থেকে তিনটি কথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে,
১. আল্লাহ তায়ালা ইচ্ছে করে তাঁর হেফাজত উঠিয়ে প্রত্যেক নবী থেকে ভুল-ত্রুটি হতে দিয়েছে, এটা ইসলামী আকিদার বিরোধী।
২. এমতাবস্থায় কোন নবীই সত্যের মাপকাঠি হতে পারেন না এবং তাঁদের উপর কোন সময়ই ভরসা করা যায়না। কেননা তাদের প্রত্যেক হুকুমেই সন্দেহ থাকবে যে, হয়ত এটা হেফাজত উঠিয়ে নেয়ার সময়ের।
৩. মাওলানা মওদূদী ও জামায়াতে ইসলামীর লোকেরা মুসলমান নন।
হযরত মাদানী সাহেবের কথাগুলো কিন্তু মেনে নেয়া যায়না। কারণ,
১. আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের সকল ওলামায়ে কিরামের ঐক্যমত রয়েছে যে ভুলবশতঃ নবীদের থেকে ছগিরা গুণাহ হতে পারে এবং জমহুর ওলামাদের মতে ইচ্ছাকৃতভাবেও ছগিরা গুনাহ হতে পারে। এমতবস্থায় যদি হেফাজত উঠানো না হয়, তবে বুঝা যাবে যে, একদিকে আল্লাহর হেফাজত আছে, আর অন্যদিকে নবীদের ভুল ত্রুটি অথা ছগিরা গুণাহ প্রকাশ পাচ্ছে, এটা কিন্তু অসম্ভব। কারণ এতে পরোক্ষভাবে আল্লাহ তায়ালা হেফাজতের উপর পূর্ণ সক্ষম নন বলে প্রকাশ পায় (নাউজুবিল্লাহ)। অতএব মানতেই হবে যে, যখনই নবীদের থেকে কোন ক্রটি-বিচ্যুতি প্রকাশ পায় তখন আল্লাহ তায়ালা ইচ্ছে করে তাঁর হেফাজত উঠিয়ে তা করতে দেন।
২. মুহাক্কেক বা নির্ভরযোগ্য ওলামাদের মতানুসারে যখনই নবীদের থেকে কোন ‘লগজীশ’ হয় তখনই তাদেরকে অবহিত করা হয়, যাতে তারা এ থেকে বিরত থাকেন।
আল্লামা তাফতাজানী এ সম্পর্কে বলেন,
মুহাক্কেম ওলামাগণ শর্ত করেছেন যে, তাঁদেরকে এর উপর (লগজিশের) যেন সতর্ক করা হয়।
আল্লামা আলুসী (রহ) বলেছেন,
মুহাক্কেক আলেমগণ শর্ত করেছেন, তাঁদেরকে যেন এর উপর অবগত করানো হয় যাতে তাঁরা এ থেকে বিরত থাকেন।[16]রুহুল মাআনই; খন্ড ১৬; পৃষ্ঠা ২৭৪
সাদরুশ শারিয়া (রহ) বলেন,
লগজিশ’ ছগিরা গুণাহের অন্তভূক্ত। যা ইচ্ছা ব্যতিরেকেই হয়ে থাকে। কিন্তু এটা অত্যাবশ্যকীয় যে, এর উপর যেন তাদেরকে অবগত করানো হয়।
আল্লামা সাইয়েদ সুলাইমান নদভী সাহেব (রহ) বলেন,
মানুষ হিসেবে তাদের থেকেও ভুল-ত্রুটি হতে পারে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তার ওহীর দ্বারা এ সমস্ত ভুল ত্রুটিরও সংশোধন করে থাকেন। [17]সিরাতুন্নবী, খন্ড ৪; পৃষ্ঠা ৭০।
পবিত্র কুরআন শরিফ থেকে দলিল।
আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করেছেন (কিন্তু) তুমি তাদেরকে কেন অনুমতি দিলে যে পর্যন্ত না সত্যবাদী লোকেরা তোমার কাছে প্রকাশ হয়ে যেত এবং তুমি মিথ্যাবাদীদেরকে জেনে নিতে? (সূরা তাওবা; ২/৪৩)
আবুল্লাহ ইবনে উবাই এর মৃত্যুর পর তার ছেলের অনুরোধে রাসূল (সাঃ) ঐ মুনাফিকের জানাযার নামায পড়াতে উদ্যত হয়ে গেলেন। সাথে সাথে আল্লাহ তায়াল ওহী দ্বারা তাকে সতর্ক করলেন এবং নামায পড়ানো থেকে বিরত রাখলেন।
তাদের কেউ মারা গেলে তুমি কক্ষনো তাদের জন্য (জানাযার) নামায পড়বে না, আর তাদের কবরের পাশে দন্ডায়মান হবে না। তারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের সঙ্গে কুফুরী করেছে আর বিদ্রোহী পাপাচারী অবস্থায় তাদের মৃত্যু হয়েছে। (সূরা তাওবা; ২/৮৪)
রাসুল (সাঃ) তার কোন স্ত্রীর মনসন্তুষ্টির জন্য মধু পান না করার কসম করেন। হালাল খাদ্য গ্রহণ না করার কসম করা রাসুল (সাঃ) এর জন্য শোভন নহে, তাই আল্লাহ তায়ালা তাকে ওহী দ্বারা অবগত করলেন।
হে নবী! আল্লাহ যা তোমার জন্য হালাল করেছেন তা তুমি কেন হারাম করছ? (এর দ্বারা) তুমি তোমার স্ত্রীদের সন্তুষ্টি পেতে চাও, (আল্লাহ তোমার এ ত্রুটি ক্ষমা করে দিলেন কেননা) আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, বড়ই দয়ালু। [18](সূরা তাহরিম; ৬৬/১)
হযরত নূহ (আঃ) সেই ঐতিহাসিক তুফানের সময় তার কাফের ছেলেকে রক্ষার জন্য আল্লাহর কাছে আবেদন করলেন। কিন্তু আল্লাহ তায়ালার কাছে তা পছন্দনীয় হল না। তাই সাথে সাথে ওহী নাযিল করলেন।
তিনি বললেন, ‘হে নূহ, সে নিশ্চয় তোমার পরিবারভুক্ত নয়। সে অবশ্যই অসৎ কর্মপরায়ণ। সুতরাং যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই, আমার কাছে তা চেয়ো না। আমি তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি, যেন মূর্খদের অন্তর্ভুক্ত না হও’। (সূরা নুহ; ১১/৪৬)
হযরত মুসা (আঃ) যখন এক ব্যক্তিকে হত্যা করে ফেলেছিলেন তখন নিজেই ঘোষণা দিয়েছেন, এটা শয়তানের কান্ড।এছাড়াও কোরআন শরীফে অনেক উদাহারণ রয়েছে। সুতরাং হযরত মাদানী সাহেবের কথা এই কথা ঠিক নয় যে, “এমতবস্থায় কোন নবীই সত্যের মাপকাঠি হতে পারেনা, তাঁদের উপর কোন সময়ই ভরসা করা যায়না, তাদের প্রত্যেক হুকুমেই সন্দেহ থাকে যে, হযরত এটা হেফাজত উঠিয়ে নেয়ার সময়ের।”
মাওলানা মওদূদী (রহ) ইছমতে আম্বিয়া সম্পর্কে কোন কথা কুরআন হাদিস কিংবা আহলে সুন্নতা ওয়াল জামায়াতের আকিদার খেলাফ বলেননি। সুতরাং, হযরত মাদানী (রহ) এর কথা অত্যন্ত মারাত্মক যে, জামায়াতে ইসলামীর লোকের এবং মাওলানা মওদূদি মুসলমান নন। আমরা বলতে বাধ্য হব যে, উপরোল্লেখিত তিনটি ব্যাপারে মাদানী সাহেবের ইজতেহাদী ভুল রয়েছে।
মাওলানা মওদূদি (রহ) যথার্থই এক মর্দে মুমিন এবং একথা বললে ভুল হবেনা যে, বিংশ শতাব্দীর তিনি এক উজ্জল নক্ষত্র। সুতরাং এমন এক ব্যক্তির ব্যাপারে মুসলমান নন শব্দটি ব্যাবহার করে মুসলিম মিল্লাতের দূর্ভাগ্যই বলতে হয়।
সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! হযরত হোসাইন আহমদ মাদানী (রহ) এর ফতোয়াটি যদি মেনে নেয়া যায়, তাহলে আল্লামা তাফতাজানী (রহ), আল্লামা আলুসী (রহ), ঈমাম ফকরুদ্দীন রাযী (রহ), হাকীমুল উম্মাত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (রহ), এমনকি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের সমস্ত ওলামায়ে কেরামদের ব্যাপারে আপনারা কি বলবেন [19]মাওলানা বশিরুজ্জামান; সত্যের আলো; পৃষ্ঠা ২৫-২৯
মাওলানা মওদূদিকে নিয়ে মিথ্যা অভিযোগ করার কারণ জানতে পড়ুনঃ মাওলানা মওদুদীর সাথে মতবিরোধের কারণ – Faith and Theology (faith-and-theology.com)
References
↑1 | সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদি; গঠণতন্ত্র, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী; পৃষ্ঠা নং-১১। |
---|---|
↑2 | সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদি; রাসায়েল ও মাসায়েল, ৫ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ১৯৮ |
↑3 | সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদি; রাসায়েল ও মাসায়েল, খন্ড নং-২; পৃষ্ঠা নং-৩৩১ |
↑4 | সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদি; রাসায়েল ও মাসায়েল; ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ৬১ |
↑5 | সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদি; রাসায়েল ও মাসায়েল; ১ম খন্ড; পৃষ্ঠা ২৮৯ |
↑6 | সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদি; খেলাফত ও রাজতন্ত্র; পৃষ্ঠা- ২৯৫ |
↑7 | সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদি; সীরাতে সরওয়ারে আলম, ১ম খন্ড; পৃষ্ঠা: ২২২-২২৩ |
↑8 | ফখরুদ্দীন রাযী, ইসমতে আম্বিয়া, পৃঃ২৮ |
↑9 | ইবনু তাইমিয়া, মাজমুউল ফাতাওয়া (৪/৩১৯) |
↑10 | শিহাব উদ্দীন আলুসী, রুহুল মা’আনী (৮/৫৮৩) |
↑11 | মোল্লা আলী কারী, মিরকাতুল মাফাতীহ, (৫/১৭২০) |
↑12 | নুমান বিন সাবিত, আল ফিকহুল আকবার, পৃ. ৩৭। ড. খন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, আল ফিকহুল আকবারঃ বঙ্গানুবাদ ও ব্যাখ্যা, পৃ. ৩০৪ |
↑13 | মুফতী মুহাম্মদ শফী, মাজালিসে হাকিমুল উম্মত. পৃ-৬৫ |
↑14 | আসলাম হোসাইন; আলোচিত অভিযোগের কাঙ্ক্ষিত জবাব, পৃষ্ঠা নং- ২৭ |
↑15 | Did the Prophet (peace and blessings of Allaah be upon him) commit sin? – Islam Question & Answer (islamqa.info) |
↑16 | রুহুল মাআনই; খন্ড ১৬; পৃষ্ঠা ২৭৪ |
↑17 | সিরাতুন্নবী, খন্ড ৪; পৃষ্ঠা ৭০। |
↑18 | (সূরা তাহরিম; ৬৬/১) |
↑19 | মাওলানা বশিরুজ্জামান; সত্যের আলো; পৃষ্ঠা ২৫-২৯ |