রমজানের ফজিলত
রমজানের ফজিলত
রমজানের ফজিলত
আরবি মাসসমূহের মধ্যে সবচেয়ে বরকতময় ও মর্যাদাপূর্ণ মাস হলো রমজান। এ মাসের গুরুত্ব ও বৈশিষ্ট্য অপরিসীম। নামাজের পড়েই মুসলিমদের জন্য যে ইবাদত ফরজ করা হয়ছে তা হলো রোজা। রোজা আবহমান কাল থেকে সকল নবীর শরিয়তের উপর ফরজ করা হয়েছে।
ফারসি শব্দ রোজার আরবি অর্থ হচ্ছে সওম, বহুবচনে সিয়াম। সওম বা সিয়ামের বাংলা অর্থ বিরত থাকা। আর সিয়াম সাধনার অর্থ– সুবহেসাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল ধরনের পানাহার, পাপাচার এবং খারাপ কাজ থেকে নিজেকে বিরত ও সংযত রাখা। এ পবিত্র মাস মানুষকে সকল রকম গর্হিত ও অনৈতিক কার্যকলাপ থেকে বিরত রাখে এবং সকলকে সাধ্যমত ইবাদাত বন্দেগি করার জন্য উৎসাহিত করে।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এরশাদ করেন,
হে ঈমানদারগণ! তোমাদের প্রতি রোযা ফরয করা হয়েছে, যেমন তোমাদের আগের লোকেদের প্রতি ফরয করা হয়েছিল, যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পার। [1]সূরা বাকারা; ১৮৩
রমজানের ফজিলত
কুরআন নাজিল
আল কোরআন ইসলাম ধর্মের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ। কুরআন আল্লাহ্র নাযিলকৃত ঐ কিতাবকে বলা হয়, যা তিনি তাঁর শেষ নবী সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)- এর উপরে দীর্ঘ তেইশ বৎসর কালব্যাপী বিভিন্ন পর্যায়, প্রয়োজন মোতাবেক অল্প অল্প করে অবতীর্ণ করেছিলেন। পবিত্র এই কুরআন সর্বপ্রথম নাযিল শুরু হয় রমজান মাসের কদরের রাতে। আর এই কারণে রমজান মাস ফজিলত পূর্ণ।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এরশাদ করেন,
রমযান মাস, যাতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে মানুষের জন্য হিদায়াতস্বরূপ এবং হিদায়াতের সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে মাসটিতে উপস্থিত হবে, সে যেন তাতে সিয়াম পালন করে।[2]সূরা বাকার;১৮৫
লাইলাতুল কদর
ফারসি শব্দ ‘শবে কদর’ শব্দের আরবি হলো ‘লায়লাতুল কদর’ যার অর্থ হলো মর্যাদাপূর্ণ রাত বা সম্মানিত রাত; কেননা এ রাতে কুরআন নাযিল হয়েছে, এ রাতে ফেরেশতাগণ নেমে আসেন এবং এ রাতে রবকত-রহমত-মাগফিরাত নাযিল হয়। লাইলাতুল কদরের রাত হচ্ছে হাজার মাসের চেয়ে উত্তম রাত। এই রাতটি মুসলমানদের জন্য ভাগ্য রজনী হিসেবে সম্মানিত।
পবিত্র কুরআনুল কারিম নাযিলের মাধ্যমে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এই রাতকে হাজারের মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ উত্তম ও মহা সম্মানিত রাত হিসেবে আমারদের জন্য দান করেছেন। প্রতিবছর রমজান মাসের শেষ দশকের রাতগুলোর মধ্যে কোনো এক বিজোড় রাত হলো ভাগ্য নির্ধারণ বা লাইলাতুল কদরের রাত।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন,
আমি কুরআনকে কাদরের রাতে নাযিল করেছি, তুমি কি জান ক্বাদরের রাত কী? ‘লাইলাতুল কদর’ হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। [3]সূরা আল কদর; ৯৭;১-৩
আত্মার পরিশুদ্ধির মাস
নিজেকে পরিশুদ্ধ করা সম্ভব হবে তখন, যখন নিজেকে সব পাপাচার থেকে বিরত রাখা যাবে। পাপ থেকে বিরত থাকার অন্যতম মাধ্যম হলো রোজা।
আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ তোমাদের কেউ সওম পালন করলে সে যেন পাপাচারে লিপ্ত না হয় এবং মূর্খের ন্যায় আচরণ না করে। কেউ তার সাথে ঝগড়া করলে বা তাকে গালমন্দ করলে সে যেন বলে, আমি সায়িম (রোযাদার), আমি সায়িম।[4]সুনানে আবু দাউদ; ২৩৬৩
আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ কেউ যদি সওম পালন করেও মিথ্যা বলা ও অপকর্ম ত্যাগ না করে, তাহলে তার পানাহার বর্জন করাতে আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই। [5] সুনানে আবু দাউদ ; ২৩৬২
রোজাদারের জন্য রয়েছে জান্নাতের বিশেষ দরজা
সাহল (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ জান্নাতের রাইয়্যান নামক একটি দরজা আছে। এ দরজা দিয়ে কিয়ামতের দিন সওম পালনকারীরাই প্রবেশ করবে। তাদের ব্যতীত আর কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। ঘোষণা দেয়া হবে, সওম পালনকারীরা কোথায়? তখন তারা দাঁড়াবে। তারা ব্যতীত আর কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে না। তাদের প্রবেশের পরই দরজা বন্ধ করে দেয়া হবে। যাতে করে এ দরজাটি দিয়ে আর কেউ প্রবেশ না করে। [6]সহিহ বুখারী; ১৮৯৬
আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
আল্লাহ্র রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ যে কেউ আল্লাহ্র পথে জোড়া জোড়া ব্যয় করবে তাকে জান্নাতের দরজাসমূহ হতে ডাকা হবে, হে আল্লাহ্র বান্দা! এটাই উত্তম। অতএব যে সালাত আদায়কারী, তাকে সলাতের দরজা হতে ডাকা হবে। যে মুজাহিদ, তাকে জিহাদের দরজা হতে ডাকা হবে। যে সিয়াম পালনকারী, তাকে রাইয়্যান দরজা হতে ডাকা হবে। যে সদাকাহ দানকারী, তাকে সদাকাহ্র দরজা হতে ডাকা হবে। এরপর আবূ বকর (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহ্র রসূল! আপনার জন্য আমার পিতা-মাতা কুরবান হোক, সকল দরজা হতে কাউকে ডাকার কোন প্রয়োজন নেই, তবে কি কাউকে সব দরজা হতে ডাকা হবে? আল্লাহ্র রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ হ্যাঁ। আমি আশা করি তুমি তাদের মধ্যে হবে। [7] সহিহ বুখারী; ১৮৯৭
রমজান মাস গুণাহ মাফের মাস
গুণাহ মাফের সর্বোত্তম মাস হলো রমজান। রমজানের দিনগুলোতে আমরা যদি একান্তই আল্লাহর জন্য রোজা রাখি এবং নিজের দোষ-ত্রুটির ক্ষমা চাই, তাহলে আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করবেন এবং অতীতের সব গুনাহও ক্ষমা করবেন।
আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি লাইলাতুল ক্বদ্রে ঈমানের সাথে সাওয়াবের আশায় রাত জেগে ‘ইবাদাত করে, তার পিছনের সমস্ত গোনাহ ক্ষমা করা হবে। আর যে ব্যক্তি ঈমানসহ সওয়াবের আশায় রমযানে সিয়াম পালন করবে, তারও অতীতের সমস্ত গোনাহ মাফ করা হবে। [8] সহিহ বুখারী; ১৯০১
আবূ তাহির ও হারূন ইবনু সাঈদ আল আইলী (রহঃ) ……আবূ হুরাইরাহ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিতঃ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ পাঁচ ওয়াক্ত সালাত, এক জুমুআহ থেকে আর এক জুমুআহ এবং এক রমাযান থেকে আর এক রমাযান, তার মধ্যবর্তী সময়ের জন্যে কাফফারাহ হয়ে যাবে যদি কাবীরাহ গুনাহ হতে বেঁচে থাকে। [9] সহীহ মুসলিম; ৪৪০
রমজান মাসে জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেওয়া হয়।
আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলতেন, আল্লাহ্র রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ রমযান আসলে আসমানের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয় আর শয়তানগুলোকে শিকলবন্দী করে দেয়া হয়। [10]সহিহ বুখারী; ১৮৯৯
রোজাদারের প্রতিদান আল্লাহ নিজেই দিবেন
আবূ বকর ইবনু আবূ শায়বাহ, যুহায়র ইবনু হারব ও আবূ সাঈদ আল আশাজ (রহঃ) …… আবূ হুরায়রাহ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মানব সন্তানের প্রতিটি নেক কাজের সাওয়াব দশ গুণ থেকে সাতশ গুণ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়া হয়। মহান আল্লাহ বলেন, “কিন্তু সিয়াম (রোজা/রোযা) আমারই জন্য এবং আমি নিজেই এর প্রতিফল দান করব। বান্দা আমারই জন্য নিজের প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং পানাহার পরিত্যাগ করেছে।” সিয়াম পালনকারীর জন্য দুটি আনন্দ রয়েছে। একটি তার ইফত্বারের সময় এবং অপরটি তার প্রতিপালক আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের সময়। সিয়াম (রোজা/রোযা) পালনকারীর মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহ তা’আলার কাছে মিশকের সুগন্ধির চেয়েও অধিক সুগন্ধময়। [11]সহিহ মুসলিম; ২৫৯৭
রমজান মাস দু‘আ কবুলের মাস
রমজান মাস আল্লাহর অফুরন্ত অনুগ্রহ লাভের অতি মূল্যবান একটি সময় আছে।এই মাসে আল্লাহর কাছে কোনো কিছু প্রার্থনা করলে আল্লাহ বান্দাকে ফিরিয়ে দেন না। রমজানে এ সময়টিতে দোয়া করে কাঙ্খিত জিনিস লাভের সুর্বণ সুযোগ গ্রহণ করতে পারে রোজাদার
আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তিনি ব্যক্তির দু’আ রদ হয় নাঃ ন্যায়পরায়ণ শাসক, রোযাদার যতক্ষণ না ইফতার করে এবং মজলুমের দু’আ। কিয়ামতের দিন আল্লাহ্ তার দু’আ মেঘমালার উপরে তুলে নিবেন এবং তার জন্য আসমানের দ্বারসমূহ খুলে দেয়া হবে এবং আল্লাহ্ বলবেনঃ আমার মর্যাদার শপথ! আমি অবশ্যই তোমাকে সাহায্য করবো, একটু বিলম্বেই হোক না কেন। [12]সুনান ইবনে মাজাহ; ১৭৫২
ইসলাম সম্পর্কিত – Faith and Theology (faith-and-theology.com)
References
↑1 | সূরা বাকারা; ১৮৩ |
---|---|
↑2 | সূরা বাকার;১৮৫ |
↑3 | সূরা আল কদর; ৯৭;১-৩ |
↑4 | সুনানে আবু দাউদ; ২৩৬৩ |
↑5 | সুনানে আবু দাউদ ; ২৩৬২ |
↑6 | সহিহ বুখারী; ১৮৯৬ |
↑7 | সহিহ বুখারী; ১৮৯৭ |
↑8 | সহিহ বুখারী; ১৯০১ |
↑9 | সহীহ মুসলিম; ৪৪০ |
↑10 | সহিহ বুখারী; ১৮৯৯ |
↑11 | সহিহ মুসলিম; ২৫৯৭ |
↑12 | সুনান ইবনে মাজাহ; ১৭৫২ |