সৃষ্টিকর্তাকে কে সৃষ্টি করেছে ?
সৃষ্টিকর্তাকে কে সৃষ্টি করেছে ?
সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব সম্পর্কীয় বিতর্কে বস্তাপচা নাস্তিকীয় যে আপত্তি শোনা যায়: সব কিছুর যদি সৃষ্টিকর্তা থাকে তাহলে সৃষ্টিকর্তাকে কে সৃষ্টি করেছে ? বা আল্লাহকে কে সৃষ্টি করেছেন ? মহাবিশ্ব অস্তিত্বে আসার জন্য একজন সর্বশক্তিমান অনাদি স্রষ্টার অস্তিত্ব প্রমাণ করার পর, সৃষ্টিকর্তাকে কে সৃষ্টি করেছে ? এই ধরণের প্রশ্ন একেবারেই অবান্তর ও শিশুসুলভ। নাস্তিকদের শিশুসুলভ এই যুক্তিটি খোলাসা করছি!
আল্লাহকে কে সৃষ্টি করেছেন ?
সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তা এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছে। যে সর্বশক্তিমান সত্তা এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন তিনি সৃষ্ট নয়। বরং তিনি স্রষ্টা। তিনি এই জগতের নিয়মকানুনের গন্ডিতে আবদ্ধ নয়।
আমাদের জগতের প্রতিটি বস্তু অস্তিত্বে আসার জন্য কোনো না কোনো কিছুর নির্ভরশীল। যেমন, আপনি এই মূহুর্তে যে ডিভাইস দিয়ে লিখাটি পড়ছেন এই ডিভাইস অস্তিত্বে আসার জন্য ডিভাইটি প্রস্তুত করার জন্য যে-সকল উপাদান ব্যাবহার করা হয়েছে তার উপর নির্ভরশীল। সে উপাদান গুলো আবার অন্য কিছুর উপর নির্ভরশীল। তো আমরা এমন নির্ভরশীলতা দেখতে পায় আমাদের এই মহাবিশ্বের ভেতরে থাকা প্রতিটি বস্তুর জন্য। প্রশ্ন হচ্ছে, সৃষ্টিকর্তা কি মহাবিশ্বের কোনো অংশ ? বা সৃষ্টকর্তা কি মহাবিশ্বের ভেতরেই অবস্থান করছে?
আচ্ছা বলুন তো, যে ডিভাইস দিয়ে আপনি লিখাটি পড়ছেন সেই ডিভাইসের প্রস্তুতকারীকে ডিভাইসের ভেতরে খুঁজে পাবেন ?
সৃষ্টিকর্তা এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন। তাই তিনি এই মহাবিশ্ব থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। মহাবিশ্বের সব কিছুই কিছু না কিছুর উপর নির্ভরশীল বলে, একই যুক্তি যদি সৃষ্টিকর্তার উপর প্রয়োগ করা হয় তাহলে সৃষ্টিকর্তার প্রকৃতির সাথে সাংঘর্ষিকতা দেখা দেয়।
আমরা আমাদের অস্তিত্বের কারণ খুঁজতে গিয়ে সৃষ্টিকর্তার ধারণা পেয়ে থাকি। সৃষ্টিকর্তা এমন কিছু নয় যাকে আমরা এম্পিরিক্যালি দেখতে পাবো বা ফিজিক্যাল ওয়ার্ল্ডে খুঁজে পাবো। বরং সৃষ্টিকর্তা হচ্ছে পরম সত্তা বা সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব হচ্ছে অনিবার্য । তার অনস্তিত্ব থাকাটা অসম্ভব, কেননা তার অস্তিত্ব থাকতেই হবে। কিন্তু আমরা হচ্ছি পার্টিকুলার বিং। আমাদের অস্তিত্ব থাকা এবং না থাকা দুটোই সম্ভব। এবং আমাদের অস্তিত্ব অনিবার্য নয়। আমি অস্তিত্বে নাও আসতে পারতাম।
সম্ভাব্য অস্তিত্বশীল জিনিসের ক্ষেত্রে বাহ্যিক কারণের প্রয়োজন হয়। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা অবসম্ভাবি অস্তিত্ব ( যার অস্তিত্ব থাকাই লাগবে) হওয়ার কারণে তার কোনো কারণের প্রয়োজন নেই। কারণ সংজ্ঞা অনুযায়ী তার অনস্তিত্ব একেবারেই অসম্ভব। এবং তিনি অসীম সত্তা। তাই সম্ভাব্য অস্তিত্বশীল সব কিছু অস্তিত্বে আসার জন্য যদি কোনো না কোনো কিছুর উপর নির্ভরশীল হয় তাহলে অসীম সত্তাও তার অস্তিত্বে আসার জন্য কোনো কিছুর উপর নির্ভরশীল হতেই হবে এমনটা নয়। যদি অসীম সত্তা তার অস্তিত্বে আসার জন্য কোনো কিছুর উপর নির্ভরশীল হয় তাহলে অসীম সত্তা ও সসীম সত্তার মধ্যে পার্থক্য রইলো কোথায় ? বা তিনি কিভাবে অসীম থাকে?
পার্টিকুলার সত্তা এবং অসীম সত্তা দুটো আলাদা ক্যাটাগরি। সুতরাং, আল্লাহকে কে সৃষ্টি করেছে বা সৃষ্টিকর্তাকে কে সৃষ্টি করেছে ? এই প্রশ্নে প্রশ্নকারি ক্যাটাগরি মিস্টেক ফ্যলাসি করে। বিবাহিত এবং কুমার যেমন একই ক্যাটাগরিতে পরেনা,তেমনি পার্টিকুলার এবং অসীমও একই ক্যাটাগরিতে পরে না। সৃষ্টি ও স্রষ্টাও একই ক্যাটাগরির অন্তভূক্ত নয়।
এছাড়া, সৃষ্টি ও স্রষ্টার প্রার্থক্য বুঝলে এই ধরণে অবান্তর প্রশ্ন কারো মাথায় ঘুর-পাক খাওয়ার কথা নয়। সৃষ্টি বলতে বুঝায়, যা কিছু একটা সময় অস্তিত্বে ছিলোনা এবং একটা নির্দিষ্ট সময়ে অস্তিত্বে এসেছে। নাস্তিকদের প্রশ্ন অনুযায়ী যদি আমরা ধরে নেয় যে সৃষ্টিকর্তারও স্রষ্টা থাকা আবশ্যক। তার মানে, সৃষ্টিকর্তা একটা সময়ে অস্তিত্বে ছিলোনা এবং নির্দিষ্ট সময়ের পর অস্তিত্বে এসেছে। তো যে-সকল নাস্তিক এমন চমক প্রদক প্রশ্ন করে মানুষকে বিভ্রান্ত করার অপ্রচেষ্টা করে যাচ্ছে, তাদের কাছে আমার প্রশ্ন, সৃষ্টিকর্তাকে যদি সৃষ্টি হতে হয় তাহলে তিনি কি আর সৃষ্টিকর্তা থাকে নাকি সৃষ্ট হয়ে যায় ?
মনে করুন, X হচ্ছে সৃষ্টিকর্তা। এখন X যদি X1 থকে সৃষ্টি লাভ করে তাহলে X কি সৃষ্টিকর্তা হবে নাকি সৃষ্ট হবে ? অবশ্যই সৃষ্ট হবে। তাহলে এই প্রশ্ন অনুযায়ী সৃষ্টিকর্তাকেই সৃষ্ট হতে হচ্ছে, যা সৃষ্টিকর্তার প্রকৃতির বিপক্ষে অবস্থান করে।
এছাড়া, সৃষ্টিকর্তাকে কে সৃষ্টি করেছে এটা একটা লোডেড কুয়েশ্চন ফ্যালাসি বা কমপ্লেক্স কুয়েশ্চন ফ্যালাসি। যেটা যেটি কোন controversial বা unjustified assumption করে করা হয়। কারণ, প্রশ্নকারী এখানে আগেই ধরে নিয়েছে যে সৃষ্টিকর্তাকে সৃষ্টি হতে হবে। কিন্তু এটা শুধুমাত্রই অনুমান। এর পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই। বিষয়টা অনেকটা এমন যে, আপনাকে হুট করে একজন এসে জিজ্ঞেস করলো ” আপনি কি এখনো বউ পেটান ?” যে আপনাকে এই প্রশ্নটি জিজ্ঞেস করেছে প্রথমত সে ধরে নিয়েছে আপনার বউ আছে, এবং আপনি তাকে পেটাতেন। সৃষ্টিকর্তার সংজ্ঞা অনুযায়ী তিনি অসীম সত্তা, যার কোনো শুরু নেই। অর্থাৎ তিনি অসৃষ্ট।
সৃষ্টিকর্তার সংজ্ঞা অনুযায়ী, তিনি অসৃষ্ট স্রষ্টা, কোনো অনস্তিত্বশীল অবস্থা থেকে তিনি অস্তিত্বে আসেনি। যার শুরু নেই তা কখনো সৃষ্ট হতে পারেনা। তিনি অসীম। অসীম সত্তা কোনো কিছু থেকে সৃষ্টি হওয়ার প্রয়োজন নেই। যদি হতো তাহলে তা আর অসীম থাকেনা।
মনে করুন, X হচ্ছে সৃষ্টিকর্তা এবং তিনি অসীম সত্তা যার কোনো শুরু নেই। এখন ধরে নিলাম, X কে X1 সৃষ্টি করলো। তো যৌক্তিক মনে কিন্তু আবারো প্রশ্ন আসবে তাহলে X1কে কে সৃষ্টি করেছে ? ধরুন, X1 কে X2 সৃষ্টি করলো। আপনি কিন্তু আবারো প্রশ্ন করবেন যে তাহলে X2 কে কে সৃষ্টি করছে ? উত্তর আসলো X2 কে X3 সৃষ্টি করেছে। এভাবে আপনি অসীম সংখ্যকবার প্রশ্নকরতে পারবেন। তারমানে হলো আপনার প্রশ্ন করার ক্রমধারা কখনোই শেষ হবেনা। কিন্তু সমস্য হচ্ছে এভাবে যদি সৃষ্টিকর্তার পিছনে আরো অসীম সংখ্যক সৃষ্টিকর্তা থাকে তাহলে আমরা কখনোই বর্তমান সময়ে পৌঁছাতে পারতাম না।
কেননা X অস্তিত্বে আসার জন্য নির্ভর করে X1 এর উপর, আবার X1 অস্তিত্বে আসার জন্য নির্ভর করে X2 এর উপর, X2 অস্তিত্বে আসার জন্য নির্ভর করে X3 এর উপর। এভাবে অনন্তকাল চলতে থাকলে X অস্তিত্বে আসার জন্য নির্ভর করে অনাদিকাল ধরে চলা সৃষ্ট কিছুর উপর। তো অনাদিকাল বা অসীম কাল ধরে নির্ভরশীলতার এই ক্রমধারা কখনোই শেষ হবেনা। এইভাবে অনাদিকাল ধরে চলা সৃষ্ট কিছুর উপর নির্ভর করলে “অনবস্থা দোষ”(Infinite regress) দেখা দিবে। যার ফলে বর্তমান সময়েই আসা সম্ভব হতোনা। সুতরাং, ইউনিভার্স সৃষ্টির কারণ যদি সৃষ্টিকর্তা হয় তাহলে সৃষ্টিকর্তার জন্য অসীম সংখ্যক কারণের প্রয়োজন নেই। বরং শুরুতে এমন একজন স্রষ্টা থাকা অনিবার্য যার পিছনে আর কোনো স্রষ্টা নেই, যিনি হচ্ছে অসীম।
এছাড়া, Law of parsimony ( মিতব্যয়িতা নিয়ম ) অনুসারে, একই জিনিসের একটি মাত্র কারণ থাকা সম্ভব। তাহলে এই ইউনিভার্সের একটি মাত্র কারণ থাকা সম্ভব। এবং সেই কারণই হলো সৃষ্টিকর্তা।
কুরআনের মত
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা পবিত্র কুরআনে তার পরিচয় এভাবেই দিয়েছেন,
বল, তিনিই আল্লাহ, এক-অদ্বিতীয়।
আল্লাহ কারো মুখাপেক্ষী নন, সকলেই তাঁর মুখাপেক্ষী।
তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং তাঁকেও জন্ম দেয়া হয়নি।
এবং তাঁর সমতুল্য কেহই নেই। [1]সূরা আল-ইখলাস; ১১২ঃ১-৪
দার্শনিকদের মতামত
অধ্যাপক এন্থনি ফ্লিউয়ের দেয়ার ইজ গড বইয়ের পরিশিষ্ঠে অধ্যাপক আব্রাহাম ভার্গসে জোরালোভাবে বলেছে,
আস্তিক নাস্তিক একটি বিষয়ে একমত হতে পারে: যদি কোনো কিছুর অস্তিত্ব থাকে, তা হলে এর আগে অবশ্যই এমন কিছু থাকতে হবে যা সব সময় অস্তিত্বশীল। চিরকালীন অস্তিত্ববান এই সত্তা কীভাবে এসেছে? এর উত্তর হলো, এটা কোনোভাবেই আসেনি। এটা সবসময় অস্তিত্ববান। [2]দেয়ার ইজ আ গড: হাউ দা ওয়ার্ল্ড’স মস্ট নটরিয়াস এথিস্ট চেইনজড হিজ মাইন্ড। … Continue reading
সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব নিয়ে সংশয় থাকলে এই লেখাটি পড়তে পারেনঃ মহাবিশ্ব সৃষ্টির রহস্য ,প্রকৃতি বনাম আল্লাহ! – Faith and Theology (faith-and-theology.com)
References
↑1 | সূরা আল-ইখলাস; ১১২ঃ১-৪ |
---|---|
↑2 | দেয়ার ইজ আ গড: হাউ দা ওয়ার্ল্ড’স মস্ট নটরিয়াস এথিস্ট চেইনজড হিজ মাইন্ড। পৃষ্ঠা নং-১৬৫ |
Nice post. I learn something totally new and challenging on sites I stumbleupon every day. Its always interesting to read articles from other authors and practice a little something from other web sites.
অসাধারণ লেখনি
শুরু থেকেই ছিলেন এটা কিভাবে সম্ভব কোন কিছুই শুরু থেকে থাকা সম্ভব নয়। আল্লাহ তায়ালা ও একসময় ছিলেন না কিন্তু তিনি সর্বপ্রথম নিজে নিজেই সৃষ্টি হয়েছেন যাকে আমরা স্বয়ম্ভ বলতে পারি। তারপর আল্লাহ তায়ালা সমস্ত কিছু সৃষ্টি করেছেন। আমি মনে করি কোন কিছুই অসীম না আমাদের জ্ঞানে ধরে না তাই আমরা অসীম মনে করি আসলে সবকিছুই সীমিত। আল্লাহ তাআলা ও সীমিত কিন্তু এই সীমিত এতই বিশাল যে আমাদের কাছে তা অসীম মনে হয় আসলে আল্লাহ সহ সবকিছুই সীমিত। আমি মনে করি অসীম বলে কোন কিছু নেই এটা আমাদের জ্ঞানে ধরে না তাই আমরা এ বিষয়টি ধরে নেই যে অসীম কিছু আছে। আল্লাহ শুরু থেকেই ছিলেন বা শুরু থেকেই অস্তিত্ববান এটা কিভাবে সম্ভব। এটাই বেশি যুক্তিসঙ্গত যে আল্লাহ একসময় ছিলেন না কিন্তু তিনি সর্বপ্রথম নিজে নিজেই সৃষ্টি হয়েছেন তারপর সমস্ত কিছু সৃষ্টি করেছেন এবং আল্লাহতালা যেদিন প্রথম নিজে নিজেই সৃষ্টি হয়েছিলেন সেই দিনটাকে এই শুরুর দিন বলা যেতে পারে। অবশ্যই আল্লাহ তায়ালাকে অস্তিত্বে আসতে হয়েছে এটা আসলেই খুবই জটিল প্রক্রিয়া যা আমাদের বোঝা খুবই কঠিন। শেষ কথা হলো আল্লাহ তায়ালা হলেন সর্বপ্রথম সৃষ্টি যাকে কেউ সৃষ্টি করেনি আল্লাহ নিজে নিজেই সৃষ্টি হয়েছেন এবং তারপর আল্লাহ তাআলা এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সহ সবকিছু সৃষ্টি করেছেন।