সূরা কুরাইশ এর তাফসীর
সূরা কুরাইশের তাফসীর
সূরা কুরাইশ এর তাফসীর
সূরা কুরাইশ
সূরা কুরাইশ পবিত্র কুরআনের ১০৬তম সূরা। সূরাটি মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে এবং এর আয়াত সংখ্যা ৪টি। এই সূরার ব্যাপারে সমস্ত তাফসীরকারকগণ একমত যে, অর্থ ও বিষয়বস্তুর দিক থেকে এই সূরার সাথে সূরা ফিলের সম্পর্ক রয়েছে।
সূরা কুরাইশ এর শানে নুযুল
সূরা কুরাইশ এর প্রথম আয়াতে উল্লেখিত “কুরাইশ” শব্দ থেকেই এই সূরাটির নামকরণ করা হয়েছে। যার অর্থ কামাই-রোযগার করা। তারা যেহেতু ব্যাবসা করে কামাই-রোজগার করে জীবিকা নির্বাহ করতো, তাই তাদের এই নাম হয়েছে। কারো কারো মতে এর অর্থ “জমায়েত করা বা একত্রিত করা।” কারণ সর্বপ্রথম তারা বিভিন্ন দিকে বিক্ষপ্ত অবস্থায় ছিলো। পরবর্তিতে কুসাই ইবন কিলাব তাদের হারামের চারপাশের জড়ো করেন। যার কারণে তাদেরকে কুরাইশ বলে সম্বোধন করা হয়েছে। কোনো কোনো স্কলারের মতে, সমুদ্রের কোনো এক বড় মাছের নামকরণে এই সূরার নাম হয়েছে। যে মাছে অন্য মাছের উপর প্রাধান্য বিস্তার করে থাকে। ঠিক তেমনি কুরাইশগণ অন্য সকল গোত্রের উপর প্রাধান্য পেয়ে থাকে। এই সূরাটিকে “সূরা ইলাফ” ও বলা হয়ে থাকে।
সূরা কুরাইশ বাংলা উচ্চারণ এবং অনুবাদ
لِاِیۡلٰفِ قُرَیۡشٍ ۙ﴿۱﴾
লিঈলা-ফি কুরাইশ। [ যেহেতু কুরাইশের আসক্তি আছে,]
اٖلٰفِهِمۡ رِحۡلَۃَ الشِّتَآءِ وَ الصَّیۡفِ ۚ﴿۲﴾
ঈলা-ফিহিম রিহলাতাশ শিতা ইয়াসসাঈফ। [ আসক্তি আছে তাদের শীত ও গ্রীষ্ম সফরে।]
فَلۡیَعۡبُدُوۡا رَبَّ هٰذَا الۡبَیۡتِ ۙ﴿۳﴾
ফাইইয়া’বুদূরাব্বা হা-যাল বাঈত। [ অতএব, তারা যেন এ গৃহের রবের ইবাদত করে।]
الَّذِیۡۤ اَطۡعَمَهُمۡ مِّنۡ جُوۡعٍ ۬ۙ وَّ اٰمَنَهُمۡ مِّنۡ خَوۡفٍ ﴿۴﴾
আল্লাযীআতা’আমাহুম মিন জূ’ইওঁ ওয়া আ-মানাহুম মিন খাওফ। [ যিনি ক্ষুদায় তাদেরকে আহার দিয়েছেন আর ভয় থেকে তাদেরকে নিরাপদ করেছেন।]
সূরা কুরাইশ এর বিষয়বস্তুঃ
সূরা কুরাইশ এর বক্তব্য এই যে, কুরাইশরা যেহেতু শীতকালে ইয়েমেনে ও গ্রীষ্মকালে সিরিয়ায় সফরে অভ্যস্ত ছিলো এবং দুটি সফরের উপর তাদের জীবিকা নির্বাহ করতো এবং তারা ঐশ্বর্যশালীরুপে পরিচিত ছিলো, তাই আল্লাহ তা’আলা তাদের শত্রু হস্তি বাহীনিকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়েছে। তাই সকল মানুষের অন্তরে তাদের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত হয়েছে। সুতরাং তাদের উচিত এই ঘর “কাবার” মালিকের ইবাদত করা, যে ঘরের মালিক তাদের সম্মানিত করেছেন।
এই কথা প্রচলিত যে, মক্কা শহর যে স্থানে অবস্থিত সেখানে কোনো চাষাবাদ হয়না। তাই বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে বিদেশে সফর ও প্রয়োজনীয় জীবনোপকরণ সংগ্রহ করা ছাড়া আর কোনো উপায় তাদের ছিলোনা। মূলত মক্কাবাসীরা খুবই দরিদ্র ছিলো এবং অনেক কষ্টে জীবন-যাপন করতো। অতপর, রাসুল (সাঃ) এর প্রতিতামহ হাশেম কুরাইশকে ভিন দেশে গিয়ে ব্যবাসা বাণিজ্য করতে উৎসাহিত করেন। সিরিয়া ছিলো ঠান্ডা দেশ, তাই গ্রীষ্ম কালে তারা সিরিয়াতে সফর করতো। অন্যদিকে ইয়েমেন ছিলো গরমদেশ তাই শীতকালে তারা সেখানে সফর করতো। বাইতুল্লার খাদেম হওয়ার কারণে তারা ছিলো সমস্ত আরবে সম্মান ও শ্রদ্ধার পাত্র। যার ফলে সফরকালীন পথের বিপদ-আপদ থেকে তারা নিরাপদ ছিলো। সূরা কুরাইশে আল্লাহ তা’আলা মক্কাবাসীদের প্রতি তার এসব নেয়মত ও অনুগ্রহ সম্পর্কে আলোচনা করে তাদেরকে ঈমান ও তাওহীদের প্রতি আহ্বান করেছেন।
রাসুল (সাঃ) বলেছেন, কুরাইশদেরকে আল্লাহ ৭টি বিষয়ে মর্যাদা দিয়েছেন।
১. রাসুল (সাঃ) বলছেন তিনি কুরাইশ থেকে এসেছেন।
২. নবুয়ত এসেছে কুরাইশ থেকে।
৩. কুরাইশরা বায়তুল্লাহ খাদেম।
৪. হজের মৌসুমে কুরাইশ বংশের লোকেরা হাজীদের জমজমের পানি পান করাতো।
৫. বাদশাহ আবরাহ যখন কাবা আক্রমণ করে তখন আল্লাহ কুরাইশদের পক্ষ নিয়ে কাবাকে রক্ষা করে।
৬. বাদশাহ আবরাহার পরাজয়ের পর কুরাইশরা টানা ১০ বছর ইবাদাত করেছেন। \
৭. কুরাআনে কুরাইশ বংশ নিয়ে আল্লাহ তা;আলা সূরা নাযিল করা হয়েছ।
সূরা কুরাইশ এর তাফসীর
১. যেহেতু কুরাইশের আসক্তি আছে,
কুরাইশ একটি গোত্রের নাম। নদীর ইবনে কিনানার সন্তানদেরকে কুরাইশ বলা হয়। কারো কারো মতে, ফিহর ইবন মালিক, ইবন নাদর, ইবন কিনানাহ এর বংশধরদের কুরাইশ বলা হয়। তবে প্রথম মতটি বেশি গ্রহণযোগ্য। [কুরতবী]
হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লহা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহ তা’আলা ঈসমাইলের বংশধর থেকে কিনানাহকে, কিনানার বংশ থেকে কুরাইশকে, কুরাইশ থেকে বনী হাশেমকে, বনী হাশেম থেকে আমাকে পছন্দ করেছেন।” [মুসলিমঃ২২৭৬]
২. আসক্তি আছে তাদের শীত ও গ্রীষ্ম সফরে,
إيلاف শব্দের অর্থ হল, স্বাভাবিক ও অভ্যাস হওয়া। অর্থাৎ, কোন কাজে কষ্ট ও বিরাগ অনুভব না হওয়া। [1]তাফসীরে আহসানুল বায়ান
কুরাইশরা ব্যাবসা বাণিজ্য করে জীবন যাপন করতো। এই কারনে প্রতিবছর তারা অন্য দেশে সফর করতো। এবং সেখান থেকে ব্যাবসার পণ্য সামগ্রী কিনে নিয়ে আসতো। শীতের মৌসুমে তারা ইয়ামান এবং গ্রীষ্মকালে তারা শাম (শিরিয়া) সফর করতো। কুরাইশরা যেহেতু কাবার খাদেম ছিলো তাই সবাই তাদেরকে কাবার খাদেম বলে সম্মান করতো। আর এই কারণেই তাদের বাণিজ্যিক কাফেলা বিনা বাধায় সফর করতে পারতো।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তালা এই সূরাতে কুরাইশদের উদ্দেশ্যে বলেন, তোমরা যে গরম ও শীতকালে অন্য দেশে সফর করো, তা হলো আমার অনুগ্রহের ফল। কারণ আমি মক্কা নগরীতে নিরাপত্তা দান করেছি এবং আরববাসীদের নিকট তোমাদেরকে সম্মানিত করেছি। যদি তা না হতো তাহলে তোমাদের সফর সফর করা সম্ভব হতোনা।
এবং হস্তীবাহীনিকেও ধ্বংস করে তোমাদের সম্মান – মর্জাদা বয়াজ রেখেছি। সুতরাং, তোমাদের উচিত, কেবলমাত্র এই বাইতুল্লার (আল্লাহর ঘর) মালিকের ইবাদাত করা।
৩. অতএব, তারা যেন এ গৃহের রবের ইবাদত করে।
আল্লাহ যেহেতু কুরাইশদের প্রতি অনুগ্রহ করেছে, তাদের সম্মানিত করেছে তাই এখন তাদের উচিত কেবলমাত্র এই বাইতুল্লার (আল্লাহর ঘরের) মালিকের ইবাদাত করা।
৪. যিনি ক্ষুদায় তাদেরকে আহার দিয়েছেন আর ভয় থেকে তাদেরকে নিরাপদ করেছেন।
মক্কায় আসার আগে কুরাইশরা যখন আরবে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় বসবাস করতো তখন তারা অনেক দরিদ্র ছিলো। পরবর্তীতে মক্কায় আসার পর তাদের জন্য রিজিকের দরজা খুলে যায়। ইব্রাহীম (আঃ) তাদের জন্য দোয়া করে বলেছিলো “হে আল্লাহ! আমি তোমার মর্যাদাশালী ঘরের কাছে একটি পানি ও শস্যহীন উপত্যকায় আমার সন্তানদের একটি অংশে বসতি স্পাপন করিয়েছি, যাতে তারা সালাত কায়েম করতে পারে। কাজেই আপনি লোকদের হৃদয়কে তাদের অনুরাগী করে দিন, তাদের খাবার জন্য ফলমূল দান করুন।” [2]সূরা ইব্রাহিম; ১৪:৩৭
ইব্রাহীম (আঃ) এর এই দো’আ হুবহু পূর্ণ হয়। [3] তাবারী, আদওয়াউল বায়ান
সে যুগে আরবের অবস্থা এমন ছিল যে, সারা দেশে এমন কোন জনপদ ছিল না যেখানে লোকেরা রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারতো। কারণ সবসময় তারা আশংকা করতো, এই বুঝি কোন লুটেরা দল রাতের অন্ধকারে হঠাৎ তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো এবং তাদের সবকিছু লুট করে নিয়ে গেলো। কিন্তু কুরাইশরা মক্কায় সম্পূর্ণ নিরাপদ ছিল। তাদের নিজেদের ওপর কোন শত্রুর আক্রমণের ভয় ছিল না। তাদের ছোট বড় সব রকমের কাফেলা দেশের প্রত্যেক এলাকায় যাওয়া আসা করতো। হারাম শরীফের খাদেমদের কাফেলা, একথা জানার পর কেউ তাদের ওপর আক্রমণ করার সাহস করতো না। [4]কুরতুবী, তাবারী
অন্যান্য তাফসীর পড়ুনঃ দারসুল কুরআন – Faith and Theology (faith-and-theology.com)
References
↑1 | তাফসীরে আহসানুল বায়ান |
---|---|
↑2 | সূরা ইব্রাহিম; ১৪:৩৭ |
↑3 | তাবারী, আদওয়াউল বায়ান |
↑4 | কুরতুবী, তাবারী |