শ্রোডিঞ্জারের বিড়াল এবং কোয়ান্টাম ম্যাকানিক্স
শ্রোডিঞ্জারের বিড়াল এবং কোয়ান্টাম ম্যাকানিক্স
পৃথিবীতে একই সময়ে আপনি শুধুমাত্র একটি স্থানেই থাকতে পারবেন। কিন্তু যদি এমনটা হয় একই সময়ে আপনি অনেকগুলো স্থানে অবস্থান নিতে পারবেন তাহলে বিষয় কেমন হয়? হয়তো ভাবছেন এটাকি আদৌ সম্ভব? হুম,এটা সম্ভব তবে সেটা কোয়ান্টাম ইউনিভার্সে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সাব-এটোমিক পার্টিকেল যেমন, ইলেকট্রন, প্রটোন, কোয়ার্ক ইত্যাদি মিলে গঠিত হয় কোয়ান্টম ইউনিভার্স। কোয়ান্টম ইউনিভার্সে কিভাবে আপনি একই সময় অনেকগুলো অবস্থানে থাকতে পারবেন তা জানার জন্য আমাদের জানতে হবে শ্রোডিঞ্জারের বিড়াল কাহিনী।
শ্রোডিঞ্জারের বিড়াল কাহীনি
শ্রোডিঞ্জারের একটা বিড়াল ছিল,যেটা আবার ছিলও না। কেমন ধোঁয়াটে মনে হচ্ছেনা? এই বিষয়টি বুঝতে হলে আমাদের “কোপেনহেগেন ইন্টারপ্রিটেশন অব কোয়ান্টাম ফিজিক্স” সম্পর্কেও জানতে হবে। “কোপেনহেগেন ইন্টারপ্রিটেশন অব কোয়ান্টাম ফিজিক্স” এর সিদ্ধান্তগুলো খুবই উদ্ভট এবং অবাস্তব মনে হবে। যেমন, কোপেনহেগেন ইন্টারপ্রিটেশন এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, কোয়ান্টাম ইউনিভার্সে কোনো পার্টিকেল বা অবজেক্টকে যতক্ষণ না দেখা হবে ততক্ষণ তা সম্ভাব্য সকল অবস্থাতে অবস্থান করবে। মনে করুন, আমাদের এই পৃথিবী হলো একটা কোয়ান্টাম মহাবিশ্ব। আর পৃথিবীর সকল অবজেক্ট বা বস্তু হলো কোয়ান্টম অবজেক্ট। এখন আপনার হাতের মোবাইলটি আপনার সামনে রেখে দিয়ে পিছনের দিকে ঘুরে তাকালেন। আপনি যখন মোবাইলটির দিকে তাকাচ্ছেন না তখন মোবাইলটি একই সময় সম্ভাব্য সকল স্থানে অবস্থান করছে। অর্থাৎ, একটি মোবাইলটি শুধুমাত্র একটি জায়গায় অবস্থান করছেনা, ভিন্ন ভিন্ন সকল সম্ভাব্য জায়গায় অবস্থান করছে। ধরুন সামনে দুটো টেবিল ছিলো, তাহলে একই সাথে মোবাইলটি দুটো টেবিলে অবস্থান করছে। আবার আপনার বাড়ির ছাদ, অন্যান্য দেশেও অবস্থান করছে। কিন্তু যখনই আপনি আপনার মোবাইলটির দিকে তাকাবেন তখনই মোবাইলটি সকল অবস্থান থেকে কলাপস করে যেখানে আপনি রেখেছিলেন সেখানেই দেখতে পাবেন। ব্যাপারটা খুবই ধোঁয়াটে মনে হলেও কোয়ান্টম মহাবিশ্বের প্রকৃতি এমনই।
আপনার দেখার উপর নির্ভর করে কোয়ান্টম পার্টিকেল তার চরিত্র পরিবর্তন করে ফেলবে। বিজ্ঞানী আরউইন শ্রোডিঞ্জার কোয়ান্টম মহাবিশ্বের এই আচরণকে সহজভাবে বুঝানোর জন্য একটি “থট এক্সপেরিমেন্ট” বা “চিন্তা পরীক্ষা” করেন। তার এই এক্সপেরিমেন্ট “শ্রোডিঞ্জার ক্যাট বা শ্রোডিঞ্জার বিড়াল” নামে পরিচিত। অস্ট্রিয়ার খ্যাতনামা তাত্ত্বিক পদার্থবিদ আরউইন শ্রোডিঞ্জার (১৮৮৭-১৯৬১) “শ্রোডিঞ্জার সমীকরণ” প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৩৩ সালে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন।
বিজ্ঞানি শ্রোডিঞ্জার একটা বাক্সে একটা বিড়াল রাখলেন। বাক্সে আরো রাখলেন একটা Radioactive Substance, Geiger Counter, হাতুরি এবং তেজস্ক্রিয় পদার্থ। তারপর বাক্সের মুখ বন্ধ করে দিলেন। Radioactive Substance কে এমনভাবে রাখা হয়েছে যা থেকে ৫০ শতাংশ রেডিয়েশন ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। যদি সেখানে রেডিয়েশন হয় তাহলে Geiger counter তা নির্ণয় করতে পারবে এবং হাতুরি তেজস্ক্রিয়তার উপর ফেলবে। যার ফলে তেজস্ক্রিয়তা পুরো বাক্সে ছড়িয়ে পরবে এবং এই কারণে বিড়ালটি আগামী এক ঘন্টার মধ্যে মারা পড়বে। আর যদি রেডিয়েশন না হয় তাহলে বিড়ালটি মারা যাবেনা।
এক্সপিরিমেন্টের এক ঘন্টা পর বিড়ালটি কোন অবস্থায় রয়েছে? খুব সহজ উত্তর। বিড়ালটি হয় মারা গিয়েছে, নয়তো যায়নি। আচ্ছা, এখন যদি প্রশ্ন করি বাক্সটি খুলে দেখার ঠিক আগ মুহূর্তে বিড়ালটির অবস্থা কী ছিল? কোয়ান্টাম ফিল্ডের নিয়ম অনুসারে আপনি যতক্ষণ পর্যন্ত বাক্সটি খুলে দেখবেন না ততক্ষণ পর্যন্ত বিড়ালটি একই সাথে জীবত এবং মৃত। আবারও বলছি, বিড়ালটি একইসাথে জীবিত এবং মৃত। এই ধরণের অবস্থান কে বলে সুপার পজিশন। কোয়ান্টম মহাবিশ্ব এমনই অববাস্তব আচরণ করে।
সুপার পজিশন বিষয়টা বোঝানোর জন্য আমাদের ফিরে যেতে হবে হাইজেনবার্গের কোপেনহেগেন ইন্টারপ্রিটেশনে। কোপেনহেগেন ইন্টারপ্রিটেশন এর মতে, একটি কোয়ান্টাম কণা একইসাথে তার সবরকম অবস্থায় থাকতে পারে। এই সবরকম অবস্থার সমন্বয়কে বলা হয় “সুপারপজিশন”। কেউ যখন কণাটিকে অবজার্ভ করবে, ঠিক তখন কণাটির একটি অবস্থান সুনির্দিষ্ট হবে।
আরেকটু সহজ করে বলার চেষ্টা করি। একটি কোয়ান্টাম কণার বিভিন্ন রকম “অবস্থা” থাকতে পারে। যেমন, একটি কোয়ান্টাম কণা একটি নির্দিষ্ট মুহূর্তে কণা হিসেবে থাকতে পারে, আবার তরঙ্গ হিসেবেও থাকতে পারে। কোপেনহেগেন তত্ত্ব অনুযায়ী, কণাটিকে অবজার্ভ করার আগ পর্যন্ত সে একইসাথে কণা এবং তরঙ্গ –উভয় অবস্থাতেই আছে। এই “উভয়” অবস্থাটিই হল সুপারপজিশন।