শক্তি সৃষ্টি বা ধ্বংস করা যায় না। তাই এই মহাবিশ্বের আদি কারণ শক্তি, স্রষ্ট্রা নয়?

শক্তি সৃষ্টি বা ধ্বংস করা যায় না। তাই এই মহাবিশ্বের আদি কারণ শক্তি, স্রষ্ট্রা নয়?

মুক্তমণা নাস্তিকদের সাথে স্রষ্টার অস্তিত্ব বিষয়ক আলোচনাতে ইদানিং একটি কথা বার বার শুনা যায় যে, শক্তির কোনো শুরু বা শেষ নেই, বা শক্তির ধ্বংস নেই। তাই আমাদের মহাবিশ্বের উৎপত্তি মূলত শক্তি থেকেই হয়েছে। কোনো ধরনের অতিপ্রাকৃতিক সত্তা বা সৃষ্টিকর্তার প্রয়োজন নেই এই মহাবিশ্বের অস্তিত্বের পেছনে। আসলেই কি মহাবিশ্বের উৎপত্তি শক্তি থেকেই হয়েছে? এর পেছনে কি আদৌ কোনো বুদ্ধিমান সত্তা রয়েছে? বিজ্ঞান কী আমাদের এমনটাই বলে? এই প্রশ্নগুলোর জবাব লিখার চেষ্টা করেছি এই আর্টিকেলে।

নাস্তিকদের এই দাবিটির উৎস হলো শক্তির সংরক্ষণর আইন, যা তাপগতিবিদ্যার প্রথম আইন হিসাবেও পরিচিত (The law of conservation of energy, also known as the first law of thermodynamics). এই আইন অনুযায়ী, একটি বদ্ধ সিস্টেমের (Closed System) শক্তি অবশ্যই স্থির থাকতে হবে – এটি বাইরের হস্তক্ষেপ ছাড়া বাড়তে বা হ্রাস করতে পারে না। মহাবিশ্ব নিজেই একটি বদ্ধ ব্যবস্থা, তাই অস্তিত্বের মোট শক্তির পরিমাণ সর্বদা একই ছিল। শক্তি যে ফর্মগুলি গ্রহণ করে, তা ক্রমাগত পরিবর্তিত হয়।[1] Fact or Fiction?: Energy Can Neither Be Created Nor Destroyed | Scientific American অর্থাৎ, শক্তি সৃষ্টি বা ধ্বংস করা যায় না; বরং, এটি শুধুমাত্র একটি ফর্ম থেকে অন্য ফর্মে রূপান্তরিত বা স্থানান্তরিত হতে পারে।

নাস্তিকদের দাবি হলো, যেহেতু শক্তির সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী শক্তি সৃষ্টি বা ধ্বংস করা যায় না তাই শক্তি শাশ্বত (Eternal). তাই মহাবিশ্বের অস্তিত্বে জন্য কোনো প্রকার স্রষ্টা বা অতিপ্রাকৃতিক শক্তির প্রয়োজন নেই। শক্তিই সব কিছুর আদি কারণ। নাস্তিকদের একতি চিরচারিত হলো কোনো একটা বক্ত্যব্যের ওই অংশটু কেটে কাজে লাগানো যা নিজেদের পক্ষে যায়। তারা ধর্ম, দর্শন, বিজ্ঞান সকল ক্ষেত্রেই এমন হটকারিতার আশ্রয়ই নিয়ে থাকে।  শক্তির সংরক্ষণের আইন এর ক্ষেত্রেও একই কাজ তারা করেছে। এটা ঠিক যে, শক্তির সংরক্ষণের আইন অনুযায়ী, শক্তি সৃষ্টি বা ধ্বংস করা যায় না; বরং, এটি শুধুমাত্র একটি ফর্ম থেকে অন্য ফর্মে রূপান্তরিত বা স্থানান্তরিত হতে পারে। তবে এই নিয়মটি একটি বদ্ধ সিস্টেমের (Closed System) জন্য প্রযোয্য। সর্ববস্থায় প্রযোয্য নয়। নাস্তিকরা এই নিয়মটি যে বদ্ধ সিস্টেমের জন্য তা লুকিয়ে কেবল মাত্র এটাই উপস্থাপন করে যে, শক্তি সৃষ্টি বা ধ্বংস করা যায় না; বরং, এটি শুধুমাত্র একটি ফর্ম থেকে অন্য ফর্মে রূপান্তরিত বা স্থানান্তরিত হতে পারে।

মহাবিশ্বের উৎপত্তি সংক্রান্ত বর্তমানে সবচেয়ে শক্তিশালী ও গ্রহণযোগ্য মডেল হলো বিগব্যাং তত্ত্ব। তত্ত্ব অনুসারে আজ থেকে ১৩.৮ বিলিয়ন বছর পূর্বে মহাবিশ্বের বর্তমান ও অতীত সকল স্থান-কাল-শক্তি-পদার্থ-পদার্থের নিয়ম সবকিছুই একই সময়ে মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে একটি বিন্দু থেকে সৃষ্টি হয়েছে। এই সময়ে সমস্থ পদার্থ অসীম ঘনত্ব এবং তীব্র তাপ সহ একটি বিন্দুর মধ্যে সংকুচিত ছিলো যাকে সিঙ্গুলারিটি বলা হয়। পরবর্তিতে একটি মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে প্রসারিত হতে শুরু করে। এবং এভাবেই মহাবিশ্বের শুরু হয়েছে। যেহেতু, এই স্থান-কাল-শক্তি-পদার্থ সব কিছুই একই স্থান থেকে সৃষ্টি হয়েছে তাই এগুলো অসীম বা শ্বাসত হতেই পারে না। মাহাবিশ্বের সস্প্রসারণ নীতি অনুযায়ী এটি অসীম নয়। বরং, এটি স্থানিক এবং অস্থায়ীভাবে সীমীত।[2] Yujin Nagasawa (2011), The Existence of God: A philosophical Introduction. Page:103

বর্তমান পদার্থবিজ্ঞান অনুযায়ী সময়ের নিখুঁত শুরুর পর্যায় হলো প্ল্যাংক যুগ। প্ল্যাঙ্ক যুগ বলতে বিগ ব্যাং এর পর 0 থেকে 10-43 সেকেন্ড সময়কে বুঝানো হয়। মহাবিশ্ব সৃষ্টির ১০−৪৩ সেকেন্ড পর পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলোর কার্যকারিতা লাভ করে। মহাবিশ্বের ইতিহাসের ন্যূনতম বোধগম্য অংশও এটি। এই মুহুর্তে কী ঘটছে তা ব্যাখ্যা করার জন্য কোনও তত্ত্ব বিজ্ঞানীদের কাছে নেই।

সাধারণ আপেক্ষিকতা অনুযায়ী প্ল্যাঙ্ক যুগের আগে একটি মহাকর্ষীয় এককতা প্রস্তাব করে (যদিও এটি কোয়ান্টাম প্রভাবের কারণে ভেঙে যেতে পারে), এবং এটি অনুমান করা হয় যে চারটি মৌলিক শক্তি (ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিজম, দুর্বল পারমাণবিক বল, শক্তিশালী পারমাণবিক বল এবং মাধ্যাকর্ষণ) সব একই শক্তি, এবং সম্ভবত একটি মৌলিক শক্তিতে একীভূত।[3] Big Bang Timeline- The Big Bang and the Big Crunch – The Physics of the Universe

গ্র্যান্ড ইউনিফিকেশন এপোক, 10-43 সেকেন্ড থেকে 10-36 সেকেন্ডে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি অন্যান্য মৌলিক শক্তি (যা একীভূত ছিলো) থেকে আলাদা হয়ে যায় এবং প্রথম দিকের প্রাথমিক কণা (এবং প্রতিকণা) তৈরি হতে শুরু করে।[4] Big Bang Timeline- The Big Bang and the Big Crunch – The Physics of the Universe  প্ল্যাংকের সময়ের প্রায় ১০−৩৫ সেকেন্ড পর থেকে মূলত মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ শুরু হয়। পদার্থ বিজ্ঞানের নিয়ম অনুসারে, যদি আমরা মহাবিস্ফোরণের এক সেকেন্ড পর মহাবিশ্বের দিকে তাকাই তাহলে আমরা ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন এবং এন্টি ইলেকট্রন (পজিট্রন) এর সমুদ্র দেখতে পাবো যা ১০ বিলিয়ন ডিগ্রি (K) উত্তপ্ত। তারপর ধীরে ধীরে মহাবিশ্ব শীতল হয়, নিউট্রনগুলো প্রোটন এবং ইলেকট্রনগুলো ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে প্রোটনের সাথে মিলিত হয়ে ডিউটেরিয়াম তৈরি করে।[5] The Big Bang – NASA Science 

10-36 সেকেন্ড থেকে 10-32 সেকেন্ড এর সময়কে মুদ্রাস্ফীতি যুগ বলা হয়। কারণ এই সময়ে শক্তিশালী পারমাণবিক শক্তির পৃথকীকরণের ফলে, মহাবিশ্ব একটি অত্যন্ত দ্রুত সূচকীয় প্রসারণের মধ্য দিয়ে যায়, যা মহাজাগতিক স্ফীতি নামে পরিচিত।[6] The Big Bang – NASA Science এভাবে বিভিন্ন পর্যায়কাল অতিক্রম করেই আমরা বর্তমান মহাবিশ্ব পেয়েছি।

সুতরাং, আমরা চাইলেও গ্র্যান্ড ইউনিফিকেশন এপোক, 10-43 সেকেন্ড এর আগের অবস্থা সম্পর্কে কিছুই জানতে পারি না। বিগ ব্যাং তত্ত্ব অনুযায়ী  সিংগুলারিটি থেকেই সব কিছুর শুরু হয়েছে। আর এই সিংগুলারিটি কেবল হাইপোথেটিক্যাল, এর বাস্তব অস্তিত্ব নেই। আমরা এটাকে ব্যাখ্যা করতে পারি না। আমাদের এই পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বের কোনো আইন সেখানে কাজ করে না। 

সাধারণভাবে যে কারোই এখানে মনে হতে পারে য বিগ ব্যাং তত্ত্ব ও শক্তির সংরক্ষণের আইন তাহলে একে অপরের সাথে সাংঘর্ষিকতা তৈরি করে। কিন্তু এখানে আসলে কোনো ধরনের সাংঘর্ষিকতা নেই। কারণ 10-43 সেকেন্ড এর আগে আমাদের পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বের যে আইন রয়েছে তা কাজ করে না। তাই মহাবিশ্ব একটি বদ্ধ সিস্টেম (Closed System) . আর শক্তির সংরক্ষণের আইন, বা তাপগতিবিদ্যার প্রথম আইন এই বদ্ধ সিস্টেমের জন্যই প্রযোয্য। 

যেহেতু 10-43 সেকেন্ড এর আগের অবস্থায় পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বের আইনগুলো বা পদার্থের সূত্রগুলো কাজ করে না, তাই একথা বলার সুযোগ নেই যে, ‘শক্তির সংরক্ষণের আইন বা শক্তি সৃষ্টি বা ধ্বংস করা যায় না; বরং, এটি শুধুমাত্র একটি ফর্ম থেকে অন্য ফর্মে রূপান্তরিত বা স্থানান্তরিত হতে পারে’ এই বিষয়গুলো 10-43 সেকেন্ড এর আগের অবস্থায়ও কাজ করবে। বরং, এই আইনগুলো বিগ ব্যাং এর পর গ্র্যান্ড ইউনিফিকেশন এপোক বা 10-43 সেকেন্ড পর থেকে কার্যকারিতা লাভ করে। মহাবিশ্বের শুরু আগে শক্তির নিত্যতার সূত্র বা শক্তির সংরক্ষণ নীতিগুলো কার্যকর নয়।

তাই মূল কথা হলো, শক্তির নিত্যতার সূত্র বা শক্তির সংরক্ষণ নীতি গ্র্যান্ড ইউনিফিকেশন এপোক বা 10-43 সেকেন্ড পর থেকে কার্যকারিতা লাভ করে একটি বদ্ধ সিস্টেম (Closed System) এর জন্য। কাজেই, ‘শক্তি সর্বাদা অস্তিত্বশীল বা শক্তি সৃষ্টি বা ধ্বংস করা যায় না’ একথাটি কেবলমাত্র তখনই সত্য যদি এবং কেবল বলা হয় এটি গ্র্যান্ড ইউনিফিকেশন এপোক বা 10-43 সেকেন্ড পর থেকে কার্যকারিতা লাভ করে একটি বদ্ধ সিস্টেম (Closed System) এর জন্য। 

Sazzatul Mowla Shanto

As-salamu alaykum. I'm Sazzatul mowla Shanto. Try to learn and write about theology and philosophy.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button