বিজ্ঞানের দর্শন; বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানবাদ

বিজ্ঞান

বিজ্ঞানের দর্শন; বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানবাদ

আস্তিকতা, নাস্তিকতা, ও ফিলোসফিক্যাল বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টি উপলব্ধি করেছি তা হলো, বর্তমান প্রজন্মের অধিকাংশ লোক সায়েন্টিজম বা বিজ্ঞানবাদে আক্রান্ত। এর কারণ হল তারা কেউই বিজ্ঞানের দর্শন সম্পর্কে তেমন কিছুই জানে না। বর্তমান যুগকে বলা হয় বিজ্ঞানের যুগ। বিজ্ঞান আমাদের পুরো জীবনকে বদলে দিয়েছে, বদলে দিয়েছে পুরো দুনিয়াকে। মানুষের জীবন যাত্রায় বিজ্ঞান যে পরিবর্তন সাধন করেছ তা আর জ্ঞানের অন্য কোনো শাখা করতে পারেনি। আমি কম্পিউটারে বসে লিখতেছি, মুঠোফোন দিয়ে আপনি মুহূর্তের মধ্যে বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে চাইলে যোগাযোগ করতে পারেন। বিজ্ঞানের এরকম অজস্র উদাহরণ আমাদের চোখের সামনে প্রতিনিয়ত ভেসে চলেছে। হয়ত বিজ্ঞানের এমন সাফল্যের কারণে মানুষের অন্তরে বিজ্ঞান সম্পর্কে বিভিন্ন মিথ্যা ধারণার জন্ম নিচ্ছে। ইচ্ছা কিংবা অনিচ্ছায় বিজ্ঞানকে তারা সৃষ্টিকর্তার আসনে বসিয়ে দিচ্ছে। বিজ্ঞানকে মনে করে সত্যের মাপকাঠি বা পুতঃপবিত্র মহান। বিজ্ঞানসিদ্ধ মানেই যেন তা সত্য হতে বাধ্য! এই যেমন বাংলাদেশের একজন লেখক জাফর ইকবাল তার লিখিত ‘আরো একটু খানি বিজ্ঞান’ বইতে এমনটাই দাবি করেছেন। শুধু জাফর ইকবালের মতো লোকেরা নয়, বিখ্যাত দার্শনিক বাট্রান্ড রাসেল বলেন, “যা যা জ্ঞান অর্জন সম্ভব তা কেবল মাত্র বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতেই সম্ভব। বিজ্ঞান যা আবিষ্কার করতে পারবে না তা কখনোই আমরা জানতে পারবো না।[1] Samir Okasha (2016), Philosophy of Science: A very short introduction (Oxford University press,2nd edition) Page; 115

বিজ্ঞানের তারিফ কিংবা বিজ্ঞানকে ভালোবাসাতে কোনো আপত্তি নেই। অথচ জগতের সকল বিষয় জানা বা পরম সত্য জানার মাধ্যম কিন্তু বিজ্ঞান নয়। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মাঝেও অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা গুলো লুকিয়ে, বিজ্ঞানকে পুঁজি করে, ধর্মীয় অনুসারীদের নিয়ে মক করে সো কল্ড নাস্তিকরা। তাদের ভাষ্যমতে স্রষ্টা, পরকাল, ফেরেশতা, ইত্যাদি বিষয়গুলোর উপর বিশ্বাস স্থাপনের চাইতে বিজ্ঞানকে অন্ধ অনুসরণ করাটা ঢের যৌক্তিক! অনেকেই হয়ত আপত্তি তুলতে চাইবেন যে কেন অন্ধ অনুসরণ শব্দটা ব্যবহার করেছি! অন্ধ অনুসরণ ব্যাবহার করার কারণ, কথিত এসব নাস্তিকরা আসলেই বিজ্ঞানকে অন্ধভাবে অনুসরণ বা বিশ্বাস করি। বিজ্ঞান পূজারিরা বৈজ্ঞানিক তত্ত্বগুলো যাচাই না করেই সত্য হিসেবে মেনে নেয়। উদাহরণস্বরূপ, যেমন আমরা বিশ্বাস করি আর্সেনিক মানুষের শরীরের জন্য খুবই বিষাক্ত। কিন্তু আমরা কয়জন সরাসরি নিজ চোখে আর্সেনিক দেখেছি? আমরা সকলেই কি আর্সেনিকের প্রভাব পরীক্ষা করে দেখেছি? বর্তমান বিশ্বের প্রায় সকল মানুষ বিশ্বাস করে যে, পৃথিবী সূর্যের চারপাশের ঘুরে। আবার ম্যাক্রো-বিবর্তনে বিশ্বাসী মানুষ মাত্রই বিশ্বাস করে যে আমরা মানুষ অন্যান্য প্রাণী থেকে বিবর্তিত হয়ে এসেছি। বিশ্বাস করি যে, পানি অক্সিজেনের দ্বিগুণ হাইড্রোজেন দিয়ে তৈরি। এভাবে আমরা সকলেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভবে বিজ্ঞানীদের দাবিগুলো অন্ধভাবে অনুসরণ বা অন্ধবিশ্বাস করি। এই অধ্যায়টি সাজানো হয়েছে সায়েন্টিজম বা বিজ্ঞানবাদে আক্রান্ত লোকদের জন্য যা মনে করে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব মানেই সত্য হতে বাধ্য বা বিজ্ঞান মানেই পুতঃপবিত্র মহান!

বিজ্ঞান কাকে বলে ?

Scientia থেকে ইংরেজি Science শব্দটির উৎপত্তি। যার অর্থ হলো জ্ঞান। সাধারণ মানুষের কাছে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, বিজ্ঞান কি? তার কাছে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সহজ বলে মনে হতে পারে। সে হয়ত বলবে, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, এবং জীববিদ্যা, ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়ে গঠিত হয় বিজ্ঞান। কিন্তু একজন দার্শনিকের কাছে যখন প্রশ্ন রাখা হবে যে, বিজ্ঞান কি? সে কিন্তু আমাদের সাধারণ মানুষের মতো উত্তর দিবে না। তিনি হয়ত বলতে পারেন, ভৌত বিশ্বের যা কিছু পর্যবেক্ষণযোগ্য, পরীক্ষণযোগ্য ও যাচাইযোগ্য এবং তার গবেষণা ও তার ফলাফল দেওয়ার মানবীয় চেষ্টাই হলো বিজ্ঞান। অথবা বলতে পারে বিজ্ঞান হলো, যে জগতে আমরা বসবাস করি তা বুঝার, ব্যাখ্যা করার এবং বোঝানোর প্রচেষ্টা। এই উত্তরটি যুক্তিসংগত। অন্যদিকে বিভিন্ন ধর্মও এই জগতকে বোঝার এবং ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে। কিন্তু ধর্মকে বিজ্ঞানের শাখা হিসেবে গণ্য করা হয় না। একইভাবে ইতিহাসবিদরাও জগতে অতীতে কি ঘটেছে তার বুঝার চেষ্টা করে। কিন্তু ইতিহাসকে বিজ্ঞানের শাখা হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। বিজ্ঞানকে আমরা দুভাগে ভাগ করতে পারি। ১. প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ২.সামাজিক বিজ্ঞান। পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, জ্যোতির্বিদ্যা, ভূতত্ত্ব এবং জীববিদ্যা, এগুলো প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত। অন্যদিকে, মনোবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, নৃতত্ত্ব এবং অর্থনীতির মতো বিষয়গুলো সামাজিক বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত। যদিও, সমাজবিজ্ঞানের মতো একটি বিষয় বৈজ্ঞানিক হতে পারে বা হওয়া উচিত কিনা তা সামাজিক বিজ্ঞানের দর্শনে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। 

Cambridge dictionary তে বিজ্ঞানের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, ভৌত জগতের গঠন এবং আচরণের যত্ন সহকারে অধ্যয়ন, বিশেষ করে পর্যবেক্ষণ, পরিমাপ এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে, এবং এই ক্রিয়াকলাপের ফলাফলগুলি বর্ণনা করার জন্য তত্ত্বগুলির বিকাশ।[2] SCIENCE | English meaning – Cambridge Dictionary

বিজ্ঞান কি? এ সম্পর্কে ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেস এর বিজ্ঞানীরা আলোকপাত করেছেন,

বিজ্ঞান প্রাকৃতিক জগৎ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের একটি উপায়। প্রাকৃতিক জগৎ সম্পর্কে জাগতিক ব্যাখ্যা প্রদানে এটি সীমাবদ্ধ। বিজ্ঞান অতিপ্রাকৃত সম্পর্কে কিছুই বলতে পারে না। স্রষ্টা আছেন নাকি নেই- এ প্রশ্নের ব্যাপারে বিজ্ঞান নিরপেক্ষ।[3] Teaching About Evolution and the Nature of Science. Page; 58

বিজ্ঞান কাকে বলে এ সম্পর্কে গণিতবিদ ও বিজ্ঞান দার্শনিক বাট্রান্ড রাসেল বলেছেন,

পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে আবিষ্কারের চেষ্টা এবং এর ওপর ভিত্তি করে যুক্তি দেখানো….পৃথিবীর কোনো নির্দিষ্ট ঘটনা সম্বন্ধে এবং ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নিয়ম সম্বন্ধে।[4]রাসেল, বি. (১৯৩৫) রিলিজিয়ন অ্যান্ড সায়েন্স। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, … Continue reading

বিজ্ঞান কাকে বলে এ সম্পর্কে নিউ মেক্সিকো ইউনিভার্সিটির ইমেরিটাস অধ্যাপক ম্যানুয়েল মোলস বলেন,

ব্যাপকভাবে বলতে গেলে, বিজ্ঞান হল কিছু আনুষ্ঠানিক পদ্ধতি ব্যবহার করে প্রাকৃতিক জগৎ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের একটি উপায়।[5] Ecology: Concepts and Applications. Page; 511

তবে বিজ্ঞানের সংজ্ঞা নিয়ে দার্শনিকদের মধ্যে বিতর্কও রয়েছে। ব্রিস্টল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক জেমস লেডিম্যান বলেন,

আমাদের সামনে বিজ্ঞানের অজস্র উদাহরণ থাকলেও বিজ্ঞানকে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায় কিংবা কোন ধরনের বিতর্কমূলক কার্যক্রম বা বিশ্বাস কে বৈজ্ঞানিক বলা হবে তা আমরা জানি না।[6] James Ladyman; Understanding Philosophy of Science. Page: 4

উপরে দেওয়া সংজ্ঞাগুলো থেকে আমরা ‘বিজ্ঞান কাকে বলে’ এই প্রশ্নের উত্তরে এহেন সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে আমাদের এই মহাবিশ্বের গঠন, এর মধ্যে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোকে ব্যাখ্যা প্রদান করাই হলো বিজ্ঞান।

বিজ্ঞানের দর্শন

বর্তমানে জীবনের প্রায় সকল ক্ষেত্রেই আমরা বিজ্ঞানের উপর নির্ভরশীল। জেনে কিংবা না জেনে অধিকাংশ মানুষ বিজ্ঞানকে প্রায়শই যৌক্তিক অনুসন্ধানের চূড়ান্ত রূপ বলে মনে করে। তাই আমাদের বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানের দর্শন সম্পর্কে জানা, বোঝা, এবং চিন্তা করা প্রয়োজন। একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল ‘কীভাবে আমরা কেবল বিশ্বাস বা মতামতের বিপরীতে জ্ঞান পেতে পারি?’ এবং এর একটি খুব সাধারণ উত্তর হল ‘বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করুন’। উদাহরণস্বরূপ, খাবারে কি পরিমাণ ফরমালিন মিশানো হলে তা মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতিকর হবে এই ব্যাপারে সাধারণ মানুষের মধ্যে যে ধারণা বা বিশ্বাসই থাকুক না কেন, একটি দেশের সরকার ততক্ষণ পর্যন্ত ফরমালি মিশানোর ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ করবেনা যতক্ষণ পর্যন্ত এ ব্যাপারে বৈজ্ঞানিক কোন প্রমাণ উপস্থাপন না করা হয়। ঠিক একইভাবে বৈজ্ঞানিক সকল মতামতকে মূল্যায়ন করা হয়।

দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা হলো জ্ঞানতত্ত্ব যা জ্ঞান ও ন্যায্যতা (knowledge and justification) সম্পর্কে অনুসন্ধান করে। জ্ঞানতত্ত্বের মৌলিক প্রশ্নগুলির মধ্যে রয়েছে: নিছক বিশ্বাসের বিপরীতে কী জ্ঞান অর্জন করা যায়? আমরা কী নিশ্চিত হতে পারি যে আমাদের কোন জ্ঞান আছে? আমরা আসলে কি কিছু জানি? পৃথিবীর সকল মানুষের মধ্যে নানা ধরনের বিশ্বাস রয়েছে। কিছু সত্য বিশ্বাস এবং কিছু মিথ্যা বিশ্বাস। কিন্তু আমরা যদি এমন কোনো কিছু বিশ্বাস করি যা বাস্তবে মিথ্যা তাহলে সে বিষয় সম্পর্কে আমরা আসলে জানি না এবং আমাদের বিশ্বাসটি মিথ্যা বলে প্রমাণিত হবে। উদাহরণস্বরূপ, কেউ বিশ্বাস করলো যে বাংলাদেশের রাজধানী হচ্ছে চট্টগ্রাম। তার মানে, বাংলাদেশের রাজধানী সম্পর্কে তার জানা নেই। যদি আমরা কোনো দাবি করি প্রস্তাব উপস্থাপন করি তাহলে অবশ্যই সেই দাবি বা প্রস্তাবটি সম্পর্কে আমাদের জানা থাকতে হবে। তবেই আমাদের দাবি বা প্রস্তাবটি সত্য এবং বিশ্বাসে পরিণত হবে। কিন্তু জ্ঞানের জন্য কি কেবল সত্য ও বিশ্বাস যথেষ্ট? ‘জ্ঞানের ত্রিপক্ষীয় বিশ্লেষণ’ অংশে আমরা এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি যে কোন প্রস্তাব জ্ঞানে পরিণত হতে হলে চারটি জিনিস অপরিহার্য। ১. প্রস্তাবটি বিশ্বাস করতে হবে ২. প্রস্তাবটি ন্যায়সংগত হতে হবে ৩. প্রস্তাবটি সত্য হতে হবে। ৪. প্রস্তাবটি ওয়ারেন্টেড হতে হবে।

জ্ঞানতত্ত্বের ঐতিহ্যগত দৃষ্টিভঙ্গি হল যে কোন প্রস্তাবকে তখনই জ্ঞান দাবি করা যেতে পারে যখন সেই প্রস্তাবটি বিশ্বাসের জন্য আমাদের কাছে পর্যাপ্ত ন্যায্যতা থাকে, অন্য কথায়, জ্ঞান হল ‘ন্যায্য সত্য বিশ্বাস’। কিন্তু কেবল মাত্র ন্যায্য, সত্য, বিশ্বাস হলেই জ্ঞানে পরিণত হয় এই দাবিটি সমস্যা যুক্ত। তাই আমরা এর সাথে আরো একটি উপাদান যুক্ত করে নিয়েছি তা হলো ‘ওয়ারেন্ট’। তাই দর্শনের একটি ক্ষেত্র যা বিজ্ঞানের দর্শনের সাথে উল্লেখযোগ্যভাবে ওভারল্যাপ করে তা হল জ্ঞানতত্ত্ব। জ্ঞানতাত্ত্বিক প্রশ্নগুলির মধ্যে রয়েছে, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি কি? কীভাবে প্রমাণ একটি তত্ত্ব সমর্থন করে? বিজ্ঞানে তত্ত্ব পরিবর্তন কি একটি যৌক্তিক প্রক্রিয়া? আমরা কি সত্যিই জানি যে বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকে সত্য বলা যেতে পারে? ইত্যাদি। সুতরাং, বিজ্ঞানের দর্শনের মূল কাজ হলো ‘বিজ্ঞান কি’? কীভাবে প্রমাণ একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকে সমর্থন করে? বিজ্ঞানের তত্ত্ব কি পরিবর্তনশীল কিনা? বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব কি চূড়ান্ত সত্য কিনা? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করা। এক কথায় বিজ্ঞানের দর্শন হলো, বৈজ্ঞানিক গবেষণার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত পদ্ধতিকে বিশ্লেষণ করা। অথবা, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে অন্তনির্হিত অনুমানগুলোকে উন্মোচিত করা এবং প্রশ্ন করা, বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতাগুলোকে নির্ণয় করা, ইত্যাদি।

একটা দৃশ্যপট কল্পনা করুন তাহলে বিষয়টি সহজে বুঝতে সহজ হবে। আতিকুর রহমান নামের একজন বিজ্ঞানী আকাশের দিকে একটা বল ছুড়ে মেরে পরীক্ষা করে দেখলেন যে ছুঁড়ে মারার পর বলটি কি তার দিকে ফিরে আসে নাকি আকাশের দিকেই চলে যায়। এভাবে সে বেশ কয়েকবার আকাশের দিকে বল ছুঁড়ে মারলো এবং প্রতিবারই একই ফলাফল আসলো যে, বলটি তার দিকেই ফিরে আসছে। যেহেতু সে কয়েকবার আকাশের দিকে বল ছুঁড়ে মারার পরেও বলটি তার দিকে ফিরে আসছে সেহেতু সে পরীক্ষা করা বন্ধ করে দিলো এবং এই সিদ্ধান্তে পৌঁছালো যে, যতবার আপনি আকাশের দিকে বল ছুঁড়ে মারবেন ততবার বল আপনার দিকে ফিরে আসবে। আপনার কাছে বিষয়টি খুবই সুস্পষ্ট মনে হতে পারে। তবে দর্শনের কাজ হচ্ছে এখানে প্রশ্ন করা যে, আতিকুর রহমান কেন এই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে ভবিষ্যতের পুনরাবৃত্তি একই ফলাফল দেবে? আমরা কীভাবে জানি এটা সত্য? সুতরাং, বিজ্ঞানের দর্শনের কাজ হলো, আতিকুর রহমান তার সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য কোনো পদ্ধতি ব্যবহার করেছে, তার ব্যবহৃত পদ্ধতির সাহায্যে সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য যে অনুমানগুলোর উপর নির্ভর করেছে তাকে প্রশ্ন করা।

বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি

ভৌত বিশ্বের যা কিছু পর্যবেক্ষণযোগ্য, পরীক্ষণযোগ্য ও যাচাইযোগ্য, এবং তার গবেষণা এবং সেই ফলাফল হলো বিজ্ঞান। অর্থাৎ, যা কিছু ভৌত নয়, পর্যবেক্ষণ ও পরিমাপ যোগ্য নয় তা নিয়ে বিজ্ঞান আলোচনা করে না। আমাদের মানবদেহ একটা ভৌত বস্তু। তাই বিজ্ঞান মানব দেহ নিয়ে আলোচনা করে। কিন্তু আমাদের দেহের সৌন্দর্য ভৌত বস্তু নয়। তাই বিজ্ঞান সৌন্দর্য নিয়ে আলোচনা করে না। সৌন্দর্য বিষয়ে আলোচনা করার জন্য ‘নন্দনতত্ত্ব’ (Aesthetic) নামে আলাদা একটা শাস্ত্র রয়েছে। একইভাবে আমাদের মন, নৈতিকতা, মূল্যবোধ, স্রষ্টার অস্তিত্ব, আত্মা, পরকাল, ইত্যাদি বিষয়ে বিজ্ঞান আলোচনা করে না। বিজ্ঞান কোনো কিছুকে প্রথমে পর্যবেক্ষণ করে হাইপোথেসিস উপস্থাপন করবে এবং সেই হাইপোথেসিসকে ধাপে ধাপে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে একটি থিওরি বা তত্ত্ব উপস্থাপন করে। তত্ত্বকে চাইলে যেকোনো সময় পরীক্ষা করা যাবে, যাচাই করা যাবে।

বিজ্ঞান বনাম ছদ্ম বিজ্ঞান

বৈজ্ঞানিক থিওরির অন্যতম একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে একে মিথ্যা প্রমাণ করা যায় এমন (Falsifiable) হতে হবে। বিংশ শতাব্দীর একজন প্রভাবশালী  অস্ট্রিয়ান দার্শনিক এবং বিজ্ঞানী কার্ল পপার এর মতে, একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের মৌলিক বৈশিষ্ট্য হল এটি মিথ্যা প্রমাণ করা যায় এমন (Falsifiable) হতে হবে।[7] Samin Okasha; Philosophy of Science: A Very Short Introduction; Page; 11 তখন থেকেই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির অন্যান্য বৈশিষ্ট্যগুলোর সাথে মিথ্যাচারযোগ্যতাকে (মিথ্যা প্রমাণ করা যায় এমন) বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মৌলিক নীতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মিথ্যাচারযোগ্যতার নিয়ম অনুসারে, একটি বৈজ্ঞানিক অনুমান শুধু মাত্র তখনই বিশ্বাসযোগ্য বলে বিবেচিত হবে যদি এটাকে মিথ্যা প্রমাণ করা যায়। এর মানে বৈজ্ঞানিক হাইপোথেসিস বা অনুমানকে অবশ্যই পরীক্ষা করা এবং ভুল প্রমাণিত করতে সক্ষম হতে হবে। একটি দৃশ্যপট কল্পনা করুন। মিছবাউল হক নামের এক ভদ্রলোক এখন পর্যন্ত যতগুলো রাজহাঁস দেখেছেন সবগুলো সাদা রং এর ছিল। তাই ভদ্রলোক অনুমান করলেন যে পৃথিবীর সমস্ত রাজহাঁস হচ্ছে সাদা। যাইহোক, ভদ্রলোকের এই অনুমানকে স্পষ্টই মিথ্যা প্রমাণ করা সম্ভব। তার এই অনুমানটি মিথ্যা প্রমাণ করার জন্য শুধু মাত্র একটি অ-সাদা রাজহাঁস আবিষ্কার করলেই যথেষ্ট। কার্ল পপার এর মতে, বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব এই শর্ত (মিথ্যাচারযোগ্যতা) পূরণ না করলে তা আদৌ বিজ্ঞান বলে যোগ্য নয়; তা নিছক ছদ্মবিজ্ঞান।

বৈজ্ঞানিক অনুমানের প্রকৃতি

কসমোলজিস্টরা আমাদের বলেন আমাদের মহাবিশ্ব সিংগুলারিটি থেকে মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে এবং ক্রমাগত সম্প্রসারিত হচ্ছে। বায়োলজিস্টরা আমাদের বলেন শিম্পাঞ্জির সাথে আমাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা কখনোই সিঙ্গুলারিটিকে অবজারভ করেনি, মহাবিশ্ব দিন দিন বড় হচ্ছে এটাও কেউ দেখেনি, কেউ কখনও একটি প্রজাতিকে অন্য প্রজাতি থেকে বিবর্তিত হতে দেখেনি। তাহলে বিজ্ঞানীরা কীভাবে এই সিদ্ধান্তগুলোতে পৌঁছেছেন? উত্তর হচ্ছে, বিজ্ঞানীরা যুক্তি (Reasoning) বা অনুমান (Inference) প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যে কোন বিষয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছায়। বিজ্ঞানীদের সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর এই প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে বৈজ্ঞানিক অনুমানের প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে হবে।

ডিডাকশন এবং ইনডাকশন

ডিডাকশন অনুমান বা ডিডাক্টিভ আর্গুমেন্ট বলতে বুঝানো হয়, যে অনুমানে আশ্রয়বাক্য গুলো সিদ্ধান্তের সত্যতার চূড়ান্ত ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। এই অনুমানের ক্ষেত্রে যদি প্রেমিস গুলো সত্য হয় তাহলে সিদ্ধান্ত সত্য হতে বাধ্য। যেমন,

প্রেমিসঃ সকল মানুষ হয় মরণশীল।

প্রেমিসঃ মিস্টার নাদরুন একজন মানুষ।

সিদ্ধান্তঃ সুতরাং, মিস্টার নাদরুন মরণশীল।

এখানে যদি প্রেমিসগুলো সত্য হয় তাহলে সিদ্ধান্ত সত্য হতে বাধ্য।

অন্যদিকে, ইনডাক্টিভ আর্গুমেন্টের বলতে বুঝানো হয়, যে অনুমানে প্রেমিস গুলো সিদ্ধান্তের সত্যতার পক্ষে এক ধরণের সমর্থন দেয় তাকে ইন্ডাকক্টিভ আর্গুমেন্ট বলে। সিদ্ধান্তের সত্যতার পক্ষে প্রেমিস গুলো যে সমর্থন যোগায় তার মাত্রার উপর ভিত্তি করে ইনডাক্টিভ অনুমান ভালো অনুমান বা মন্দ অনুমান হিসেবে মূল্যায়ন করা যেতে পারে। প্রেমিসগুলো সিদ্ধান্তের সত্যতার পক্ষে যত বেশি সমর্থন দিবে ইনডাক্টিভ অনুমানের মূল্যও তত বেড়ে যাবে; সমর্থনের মাত্রা যত কমবে মূল্যও তত কমবে। এক্ষেত্রে ইনডাক্টিভ অনুমান ডিডাক্টিভ অনুমানের মতো নিশ্চিত কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারে না। ইনডাক্টিভ অনুমানে সমসময় সম্ভাবতার দিকটাই নির্দেশ করে। যেমন,

প্রেমিসঃ সীমান্ত বাজার থেকে ১০টি পাউরুটি কিনেছে।

প্রেমিসঃ সীমান্ত বাসায় এসে ৮টা পাউরুটি খুলে দেখেছে সেগুলো খুব ভালো।  

প্রেমিসঃ সবগুলো পাউরুটিতে একই মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ দেওয়া।

সিদ্ধান্তঃ সুতরাং, বাকি পাউরুটি গুলোও ভালো।

এখানে সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে সবগুলো পাউরুটি ভালো নাকি খারাপ তা দেখা হয়নি। অধিকাংশ পাউরুটি যেহেতু ভালো এবং সবগুলোর মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ এক থাকার কারণে অনুমান করে নেওয়া হয়েছে যে, বাকি পাউরুটিগুলো সম্ভবত ভালো। যদিও প্রথম ৮টি পাউরুটি ভালো ছিলো, এবং সবগুলো পাউরুটির মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ একই, তবুও এটা সম্ভব যে বাকি দুটো পাউরুটি আসলে ভালো নাও হতে পারে। সুতরাং, যৌক্তিকভাবে ইন্ডাক্টিভ অনুমানে সিদ্ধান্ত মিথ্যা হতে পারে। তবে দৈনন্দিন জীবনে আমাদের ইন্ডাক্টিভ অনুমানের উপর অনেকাংশেই নির্ভর করতে হয়। একটা দৃশ্যপট কল্পনা করুন। মিছবাউল হক প্রতিদিন বিকেলে তাদের স্কুলের মাঠে বন্ধুদের সাথে ক্রিকেট খেলে। প্রতিদিন বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় মিছবাউল হক কিন্তু এ ব্যাপারে নিশ্চিত নয় যে আজ তার বন্ধুরা আসবে কিনা! যেহেতু প্রতিদিন তার বন্ধুরা আসে তাই সে অনুমান করে নিয়েছে যে আজও তারা আসবে। কিন্তু যৌক্তিকভাবে এটা সম্ভব যে কোনো একদিন তার বন্ধুরা খেলতে নাও আসতে পারে। মিছবাউল হকের এই অনুমানটি ইন্ডাক্টিভ, ডিডাক্টিভ নয়।

বিজ্ঞান কি ইন্ডাক্টিভ অনুমানের উপর নির্ভর করে?

উত্তর হচ্ছে, হ্যাঁ। বিজ্ঞান ইন্ডাক্টিভ অনুমানের উপর নির্ভর করে। আমরা ইতিমধ্যে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করেছি। পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষণ, এবং তার গবেষণার ফলাফলই হলো বৈজ্ঞানিক থিওরি বা তত্ত্ব। তাহলে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হওয়ার প্রথম শর্ত হলো পর্যবেক্ষণ যোগ্য হতে হবে। আমাদের পর্যবেক্ষণের মধ্যে অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। একটি দৃষ্টান্ত লক্ষ্য করুন। মনে করুন, আপনি সকালের নাস্তা শেষে পত্রিকা পড়তে বসলেন এবং সেখানে একটি প্রতিবেদন পড়লেন যে, বিজ্ঞানীরা পরীক্ষামূলক প্রমাণ পেয়েছে যে আনাসর এবং দুধ একই সাথে খাওয়া নিরাপদ। ‘বিজ্ঞানীরা পরীক্ষামূলক প্রমাণ পেয়েছে’ এর মানে কি বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর সকল মানুষের উপর আনারস এবং দুধ একই সাথে খাইয়ে পরীক্ষা করেছেন এবং এটা কারো কোন ক্ষতি করেনি? প্রকৃত পক্ষে এমন কিছুই ঘটেনি। বিজ্ঞানীরা তাদের নাগালের মধ্যে কিছু সংখ্যক মানুষের উপরে পরীক্ষা করে দেখেছেন যে, আনারস এবং দুধ একই সাথে খাওয়ার পরে তাদের কোনো রকমের ক্ষতি হয়নি। এই পরীক্ষা থেকে বিজ্ঞানীরা অনুমান করেছেন যে, আনারস আর দুধ একই সাথে খাওয়া আমাদের জন্য নিরাপদ। কিছুদিন পর যদি কোন একটি স্থানে বিজ্ঞানীরা পরীক্ষণ করে দেখে যে, আনারস আর দুধ একই সাথে খাওয়ার পর মানুষ অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে তাহলে ‘আনাসর এবং দুধ একই সাথে খাওয়া নিরাপদ’ এই অনুমান বা তত্ত্বটি ভুল প্রমাণিত হবে। তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ক্ষেত্রে পর্যবেক্ষণ বৃদ্ধি বা পরিবর্তন হওয়ার পর অনুমান ভুল প্রমাণিত হতে পারে। আবার ইন্ডাক্টিভ আর্গুমেন্টেও পর্যবেক্ষণ যত বেড়ে যাওয়া বা পরিবর্তন হওয়ার সাথে সাথে সিদ্ধান্ত ভুল বা পরিবর্তন হতে পারে। সুতরাং, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ইন্ডাক্টিভ আর্গুমেন্ট বা অনুমানের উপর নির্ভরশীল।

প্রবলেম অব ইন্ডাকশন

একটা দৃশ্যপট কল্পনা করুন। একদল বিজ্ঞানী এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করে জানতে পারলো সেখানকার সকল রাজহাঁস সাদা। কিছুদিন পর তারা আবার ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করে জানতে পারলো ইউরোপের সকল রাজহাঁস সাদা। কিছুদিন পর তারা আবার অ্যামেরিকা মহাদেশে ভ্রমণ করে জানতে পারলো যে সেখানকারও সকল রাজহাঁস সাদা। এই পর্যবেক্ষণের উপর ভিত্তি করে ওই বিজ্ঞানীরা সিদ্ধান্তে পৌঁছালো যে পৃথিবীর সকল রাজহাঁসের রং সাদা। এই উদাহরণটি যদি আমরা প্রেমিস আকারে উপস্থাপন করি তাহলে এমন হবে;

প্রেমিসঃ এশিয়ার সকল রাজহাঁসের রং সাদা।

প্রেমিসঃ ইউরোপের সকল রাজহাঁসের রং সাদা।

প্রেমিসঃ অ্যামেরিকার সকল রাজহাঁসের রং সাদা।

সিদ্ধান্তঃ সুতরাং, পৃথিবীর সকল রাজহাঁসের রং সাদা।

বিজ্ঞানীরা এখানে কয়েকটি দেশের রাজহাঁস পর্যবেক্ষণ করে বা বিশেষ বিশেষ দৃষ্টান্তের উপর পর্যবেক্ষণ করে দেখেছে যে সেগুলো সব সাদা রং এর। এই পর্যবেক্ষণের উপর ভিত্তি করে বিজ্ঞানীরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, পৃথিবীর সকল রাজহাঁস হচ্ছে সাদা। এক্ষেত্রে যদি বিজ্ঞানীরা কখনোই সাদা ব্যতিত অন্য কোনো রং এর রাজহাঁস দেখতে পায় তাহলে তাদের সিদ্ধান্ত বা অনুমানটি মিথ্যা বলে বিবেচিত হবে। এই অনুমানের ক্ষেত্রে বিশেষ বিশেষ বাস্তব অভিজ্ঞতা বা পর্যবেক্ষণ থেকে একটা সার্বিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত যুক্তি বাক্যের মধ্যে নিহিত থাকে না বা সিদ্ধান্ত অনিবার্যভাবে যুক্তি বাক্য থেকে আসে না। যেমনটি অবরোহ বা ডিডাক্টিভ যুক্তির ক্ষেত্রে হয়। আবার এই যুক্তিগুলোর ক্ষেত্রে শতভাগ নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না। কারণ পর্যবেক্ষণ পরিবর্তন হলে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হবে। তাই এই যুক্তিগুলো সম্ভাবনামূলক। একে বলে ইন্ডাক্টিভ পদ্ধতি। 

ইন্ডাক্টিভ আর্গুমেন্টের জন্য উপরে আমরা যে উদাহরণগুলো দিয়েছিলাম সেগুলো আবার স্মরণ করি। আমরা দেখেছি সীমান্ত বাজার থেকে ১০টা পাউরুটি কিনেছে এবং ৮টি পাউরুটি ভালো পেয়েছে বিধায় বাকি দুইটি পাউরুটিও ভালো হবে বলে অনুমান করেছিল। আবার মেসবাউল হক প্রতিদিন মাঠে গিয়ে তার বন্ধুদের খেলতে দেখে বিধায় সে অনুমান করে নিয়েছে যে আজও তার বন্ধুরা মাঠে খেলবে। ইন্ডাক্টিভ অনুমানের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাচ্ছি, আমাদের অনুমান নির্ভর করে যে বস্তুগুলি বা দৃষ্টান্তগুলি আমরা পরীক্ষা করিনি সেগুলি পরীক্ষিত বস্তু বা দৃষ্টান্তগুলোর মতো একই রকম হবে। অর্থাৎ, সীমান্ত ১০টা পাউরুটি থেকে ৮ পরীক্ষা করে দেখেছে কিন্তু ২টা সে পরীক্ষা করে দেখেনি। যেহেতু ৮টা ভালো দেখেছে এবং সবগুলোর মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ একই তাই সে বাকি দুটো পরীক্ষা না করেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে বাকি দুটিও ভালো হবে। অন্যদিকে, মিসবাহ উল হক প্রতিদিন মাঠে গিয়ে তার বন্ধুদের খেলতে দেখে। তাই সে প্রতিদিন এই অনুমান করেই বাসা থেকে মাঠের উদ্দেশ্যে বের হয় যে, আজও তার বন্ধুরা মাঠে খেলতে আসবে। এখানে সে কিন্তু আজ মাঠে গিয়ে দেখে আসেনি তার বন্ধুরা মাঠে খেলে কিনা। সুতরাং, আমরা দেখতে পাচ্ছি আমাদের এই অনুমানগুলো বিশেষ বিশেষ দৃষ্টান্ত থেকে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে, যে দৃষ্টান্ত যেগুলো আমরা এখনো পরীক্ষণ করিনি সেগুলোও একই হবে। এ ধরনের অনুমানকে দার্শনিক ডেভিড হিউম প্রকৃতির অভিন্নতা বলে অভিহিত করেছেন। প্রকৃতির অভিন্নতা বলতে বুঝানো হয়, যে বস্তু বা দৃষ্টান্তগুলো আমরা পরীক্ষা করে দেখেনি সেগুলো পরিক্ষত বস্তু বা দৃষ্টান্তের মত একই হবে। যেমন, ১০টির মধ্যে যেহেতু ৮টি ভালো সেহেতু বাকিগুলো ভালো হবে। বিগতদিন যেহেতু মিসবাউল হকের বন্ধুরা মাঠে খেলতো তাই আজও তার বন্ধুরা মাঠে খেলবে। এশিয়া, ইউরোপ, অ্যামেরিকার সবগুলো রাজহাঁস সাদা তাই পৃথিবীর সমস্ত রাজহাঁসও সাদা। এক্ষেত্রে প্রকৃতি অভিন্ন বা একই রকম আচরণ করছে। কিন্তু আমরা কি জানতে পারি প্রকৃতির অভিন্নতা অনুমান সত্য? আমরা কি কোনোভাবে প্রকৃতির অভিন্নতা অনুমান এর সত্যতা প্রমাণ করতে পারি? এর উত্তরে দার্শনিক ডেভিড হিউম বলেন, “না, আমরা পারি না।”

যৌক্তিকভাবে এটা সম্ভব যে ১০ টার পাউরুটির ৮টা ভালো এবং সবগুলোর মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ একই হলেও বাকি দুটো পাউরুটির দুটো অথবা ১টি পাউরুটি খারাপ হতেই পারে। এমনটিও হতে পারে যে, মেসবাহ উল হক প্রতিদিন মাঠে গিয়ে তার বন্ধুদের খেলতে দেখলেও এমন কোন দিন আসতেই পারে যেদিন তার বন্ধুরা মাঠে খেলতে আসেনি। অথবা, এশিয়া, ইউরোপ, এবং অ্যামেরিকাতে যতগুলো রাজ হাঁস আমরা দেখেছি তার সবগুলো সাদা হলেও আমরা কখনো হয়ত কালো রং এর রাজহাঁস দেখতে পারি। এক্ষেত্রে একটি বাস্তব উদাহরণ দেওয়া যায়। ১৬৬৭ সাল পর্যন্ত ইউরোপে মনে করা হতো, পৃথিবীর সকল রাজহাঁস সাদা। কেননা, ততদিন পর্যন্ত আমাদের পর্যবেক্ষণলব্ধ সকল রাজহাঁসের রং ছিল সাদা। কিন্তু ১৬৯৭ সালে উইলিয়াম দ্যা ব্লামিং অস্ট্রেলিয়াতে কালো রাজ হাস আবিষ্কার করেন। এতে করে (All swans are white and have always been white) এই তত্ত্বটি ভুল সাব্যস্ত হয়ে যায়। সুতরাং, আমরা দেখতে পাচ্ছি প্রকৃতি ভিন্ন আচরণ করছে। তাই আমরা প্রকৃতির অভিন্ন অনুমানকে সত্য প্রমাণ করতে পারি না। ইন্ডাক্টিভ অনুমান বা যুক্তিগুলো সম্ভাবনামূলক।     

বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা

ভৌত বিষয় সম্পর্কে বিজ্ঞানের চেয়ে বেশি জ্ঞান জ্ঞানের অন্য কোনো শাখা দিতে পারবে না হয়ত। কিন্তু এই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মাঝে অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা গুলোর মধ্যে অন্যতম,

১. পর্যবেক্ষণের মাঝে সীমাবদ্ধ।

২. পরম বা নিশ্চিত সত্য জানাতে পারেনা।

৩. নৈতিকতা বা ভালো-মন্দ নির্ধারণ করতে পারেনা। 

৪. ‘কেন ঘটে?’ এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনা।

৫. অধিবিদ্যাগত বিষয়ের উত্তর দিতে পারেনা। 

৬. স্বতঃসিদ্ধ বিষয় নিয়ে আলোচনা করে না।

পর্যেবক্ষণের মাঝে সীমাবদ্ধ

বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা গুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হলো পর্যবেক্ষণের মাঝে সীমাবদ্ধতা। কোনো বিজ্ঞানী ৫ বছর বয়সী শিশুদের মাঝে কোন ধরনের খেলার প্রতি আগ্রহ তা বের করতে চাইলো। এ ক্ষেত্রে একটা ফাঁকা ঘর কিংবা খেলার মাঠে ক্রিকেট, ফুটবল, টেনিস, হকি ইত্যাদি খেলার সামগ্রী সাজিয়ে রাখা হলো। এরপর ৫বছর বয়সী একদল শিশুদের উক্ত খেলার মাঠ কিংবা ফাঁকা ঘরে ছেড়ে দিয়ে তিনি শিশুদের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করবেন। এখানে বিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণ পরিক্ষণের সময় উপস্থিত থাকা শিশুর সংখ্যার মাঝে সীমাবদ্ধ। বিজ্ঞান দার্শনিক এলিয়েট সোবার তার এম্পিরিজম প্রবন্ধে লিখেন,

যে-কোনো মুহূর্তে বিজ্ঞানীরা তাদের নাগালের মাঝে থাকা পর্যবেক্ষণ দ্বারা সীমাবদ্ধ। ………সীমাবদ্ধতা হলো যে, বিজ্ঞান তার মনোযোগ সীমিত করতে বাধ্য হয় এমন সমস্যাগুলোর দিকে যা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সমাধান করা যায়।[8] The Routledge Companion to Philosophy of Science; Page: 137-38

বিজ্ঞান কি পরম চূড়ান্ত সত্য বা নিশ্চয়তার দিকে নিয়ে যায় ?

বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা গুলোর মধ্যে অন্যতম একটি সীমাবদ্ধতা হলো বিজ্ঞান আমাদের চূড়ান্ত সত্য জানাতে ব্যার্থ। বিজ্ঞান নিয়ে অনেক বড় বড় দার্শনিক থেকে শুরু করে বিজ্ঞানীদের মধ্যেও ভুল ধারণা রয়েছে। বিশেষ করে নাস্তিক বিজ্ঞানী বা দার্শনিকদের মাঝে। তারা বিজ্ঞানের থিওরিকে বা বিজ্ঞান কোনো কিছু দাবি করলে সেটাকে পরম সত্য হিসেবে মেনে নেয়। দার্শনিক বাট্রান্ড রাসেল বলেন,

যা যা জ্ঞান অর্জন সম্ভব তা কেবল মাত্র বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতেই সম্ভব। বিজ্ঞান যা আবিষ্কার করতে পারবে না তা কখনোই আমরা জানতে পারবো না।[9] Samir Okasha (2016), Philosophy of science: A very short introduction (Oxford university press, 2nd edition) Page: 115

বাংলাদেশে কথিত বুদ্ধিজীবী জাফর ইকবাল তার লিখিত আরো একটু খানি বিজ্ঞান বইতে এমনটাই দাবি করেছেন।[10] জাফর ইকবাল;আরো একটু খানি বিজ্ঞান; পৃষ্টা নং-১৭ কিন্তু বিজ্ঞান কখনোই আমাদের চূড়ান্ত সত্য জানাতে পারে না। মজার বিষয় হচ্ছে, তাদের এই কথাই (বিজ্ঞান সত্য জানার মাধ্যম) বিজ্ঞান দিয়ে প্রমাণ করার কোনো উপায় নেই। ‘বিজ্ঞান পরম সত্য জানার মাধ্যম’ এই দাবি নিজেই একটা মেটাফিজিক্যাল স্টেটমেন্ট যেটাকে আমরা চাইলেই বিজ্ঞান দিয়ে প্রমাণ করতে পারবো না। সুতরাং, বিজ্ঞান পরম সত্য জানার মাধ্যম বা বিজ্ঞান নিশ্চয়তার দিকে নিয়ে যায়, এটা এমন একটি আত্মঘাতী কথা যে, “বাংলা বাক্যে তিন শব্দের চেয়ে বড় কোনো বাক্য নেই।” এই বাক্যেই তিন শব্দের চেয়ে বড় শব্দ রয়েছে।  অনেক দার্শনিক মনে করেন যে দার্শনিক অনুসন্ধানের নিজস্ব পদ্ধতি আছে, যার মাধ্যমে সত্যকে প্রকাশ করতে পারেন যেটা বিজ্ঞান পারে না। দার্শনিক পদ্ধতিগুলোর মধ্যে রয়েছে যুক্তি, চিন্তার পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবহার, এবং ধারণাগত বিশ্লেষণ।

বৈজ্ঞানিক থিওরি বেশ কিছু কারণে আমাদের নিশ্চিত জ্ঞান পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারেনা। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, 1. The problem of induction 2. Scatter graph problem   

The problem of induction

আমরা জেনেছি বিজ্ঞান ইন্ডাক্টিভ অনুমানের উপর নির্ভর করে। ইন্ডাকশনের সমস্যা নিয়ে ইতোমধ্যেই উপরে বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। আমরা দেখেছি ইন্ডাক্টিভ অনুমানের সাহায্যে আমরা সম্ভাবনামূলক উত্তর পেয়ে থাকি, নিশ্চিত কিছু না। ইন্ডাক্টিব আর্গুমেন্টের আলোচনায় যে উদাহরণগুলো আমরা দিয়েছিলাম তার যে কোন একটিকে আবার স্মরণ করি। একদল বিজ্ঞানী এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করে জানতে পারলো সেখানকার সকল রাজহাঁস সাদা। কিছুদিন পর তারা আবার ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করে জানতে পারলো ইউরোপের সকল রাজহাঁস সাদা। কিছুদিন পর তারা আবার অ্যামেরিকা মহাদেশে ভ্রমণ করে জানতে পারলো যে সেখানকারও সকল রাজহাঁস সাদা। এই পর্যবেক্ষণের উপর ভিত্তি করে ওই বিজ্ঞানীরা সিদ্ধান্তে পৌঁছালো যে পৃথিবীর সকল রাজহাঁসের রং সাদা।

এই উদাহরণটি যদি আমরা প্রেমিস আকারে উপস্থাপন করি তাহলে এমন হবে;

প্রেমিসঃ এশিয়ার সকল রাজহাঁসের রং সাদা।

প্রেমিসঃ ইউরোপের সকল রাজহাঁসের রং সাদা।

প্রেমিসঃ অ্যামেরিকার সকল রাজহাঁসের রং সাদা।

সিদ্ধান্তঃ সুতরাং, পৃথিবীর সকল রাজহাঁসের রং সাদা।

এখানে বিজ্ঞানীরা বিশেষ বিশেষ দৃষ্টান্ত থেকে আমাদের একটা সার্বিক সিদ্ধান্ত দিয়েছে। এখন এই সিদ্ধান্তটি কিন্তু যে কোনো সময় ভুল প্রমাণিত হতে পারে। যেমন, ১৬৬৭ সাল পর্যন্ত ইউরোপে মনে করা হতো, পৃথিবীর সকল হাস সাদা। কেননা ততদিন পর্যন্ত আমাদের পর্যবেক্ষণলব্ধ সকল হাঁস ছিল সাদা রং এর। কিন্তু ১৬৯৭ সালে উইলিয়াম দ্যা ব্লামিং অস্ট্রেলিয়াতে কালো রাজ হাস আবিষ্কার করেন। এতে করে (All swans are white and have always been white) এই তত্ত্বটি ভুল প্রমাণিত হয়ে যায়। সুতরাং, আমরা দেখতে পাচ্ছি পর্যবেক্ষণ বৃদ্ধি পেলে বৈজ্ঞানিক থিওরি যে কোনো সময় ভুল প্রমাণিত হতে পারে। আর যেটা ভুল হতে পারে বা ভুল হয় সেটা কখনোই চূড়ান্ত সত্য হতে পারে না।  যেটা সত্য সেটা সব সময় সত্য। সত্যের মধ্যে মিথ্যা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। কিন্তু বিজ্ঞানের থিওরি মিথ্যা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এ কথার প্রেক্ষিতে আরও কিছু বাস্তব উদাহরণ দেওয়া যায়। যেমন, নিউটনের তত্ত্ব বিজ্ঞান মহলে পুরো দুইশত বছর টিকে ছিল। এই দুইশত বছর বিজ্ঞান পূজারি থেকে সাধারণ মানুষও এই তত্ত্বকে সত্য হিসেবে মেনে নিয়েছিল। কিন্তু আলবার্ট আইনস্টাইন নিউটনের তত্ত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করে দেয়।

একটা সময় বিজ্ঞানীরা মনে করতো পৃথিবী স্থির হয়ে আছে এবং চন্দ্র, সূর্য, ও অন্যান্য জ্যোতিষ্ক তার চারদিকে ঘুরছে। এই মতবাদ ভূকেন্দ্রিক মতবাদ (Geo-centric theory)  হিসেবে পরিচিত। জ্যোতির্বিজ্ঞানী টলেমি মূলত এই মতবাদের প্রবর্তক। কিন্তু ষোড়শ শতাব্দীর জ্যোতির্বিজ্ঞানী কোপার্নিকাস দেখালেন যে, টলেমির এই সিদ্ধান্ত ভুল। তিনি প্রচার করলেন, সূর্য স্থির, পৃথিবীসহ অন্যান্য গ্রহ তাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে। তার এই মতবাদকে সূর্যকেন্দ্রিক মতবাদ (Helio-centric theory) বলে। বর্তমানে বিজ্ঞান আবার আমাদের জানায় সবকিছুই নিজ নিজ অক্ষে ঘূর্ণায়মান। মহাবিশ্ব কীভাবে সৃষ্টি হয়েছে? এই বিষয়ে একটা সময় বিজ্ঞানীরা মনে করতো মহাবিশ্বের কোন শুরু নেই। যাকে বলে Steady State Theory (অটল মহাবিশ্ব মডেল)। কিন্তু বর্তমানে আমরা জানতে পারি মহাবিশ্ব বিগ ব্যাং এর মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে। সুতরাং, আমরা দেখতে পাচ্ছি বিজ্ঞান প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। পরিবর্তনশীল কোন কিছু কখনোই চূড়ান্ত সত্য হতে পারে না। 

Scatter graph problem

Scatter graph problem হচ্ছে, একই পর্যবেক্ষণ থেকে একাধিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া। যেমন; আমাদের কাছে ১০০টি বিন্দু রয়েছে। এগুলো হলো তথ্য। আমাদেরকে যদি এই তথ্য থেকে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে বলা হয় তাহলে দেখা যাবে, কেউ এগুলো দিয়ে একটা সরলরেখা তৈরি করেছে, কেউ বক্ররেখা তৈরি করেছে, কেউ ত্রিভুজ, চতুভূজ, বর্গক্ষেত্র তৈরি করেছে। অর্থাৎ, একই পর্যবেক্ষণ ও তথ্য অনেকগুলো তত্ত্বের সম্ভাবনা রাখে। সম্ভাব্য তত্ত্বগুলো ক্রমান্বয়ে পরিবর্তন হওয়ার ফলে বৈজ্ঞানিক থিওরিও প্রতিনিয় পরিবর্তন হয়। যার ফলে থিওরি কখনোই আমাদের নিশ্চিত জ্ঞান পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনা। এটাই হলো Scatter graph problem.

বিশেষজ্ঞদের মত

প্রখ্যাত পদার্থবিদ ফ্রিম্যান ডাইসন নিউ ইয়র্ক রিভিউতে এক আর্টিকেলে লিখেন,

বিজ্ঞান সম্পর্কে মানুষজনের একটা বিকৃত দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। বাচ্চাকাচ্চাদের স্কুলে শেখানো হয় যে, বিজ্ঞান হচ্ছে সুপ্রতিষ্ঠিত সত্যের সমাহার! আসলে বিজ্ঞান কোন ‘কালেকশন অব ট্রুথ’ নয়। বিজ্ঞান হচ্ছে ক্রমাগত রহস্য উন্মোচন।[11] Quote by Freeman John Dyson: “The public has a distorted view of science beca…” (goodreads.com)

Stanford Encyclopedia of Philosophy তে বলা হয়েছে, বৈজ্ঞানিক তত্ত্বগুলোর একটা নির্দিষ্ট মেয়াদ রয়েছে। বিজ্ঞানের ইতিহাসের দিকে একটু লক্ষ করলে একসময়ে প্রভাবশালী ও গ্রহণযোগ্য এমন অনেক তত্ত্ব চোখে পড়বে, যেগুলো আজ বিজ্ঞানের ইতিহাসে পড়ানো হচ্ছে। অর্থাৎ সেগুলো আর গ্রহণযোগ্য নয়।[12] Realism and Theory Change in Science (Stanford Encyclopedia of Philosophy)

ইংরেজ তাত্ত্বিক পদার্থবিদ, কসমোলজিস্ট এবং লেখক, স্টিফেন হকিং তার লিখিত, ‘A brief history of time’ বইতে বলেন,

যেকোনো ভৌত তত্ত্ব সর্বদা অস্থায়ী হয়, এই অর্থে যে এটি শুধু মাত্র একটি অনুমান: আপনি এটি প্রমাণ করতে পারবেন না। পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল যতবারই কিছু তত্ত্বের সাথে একমত হোক না কেন, আপনি কখনই নিশ্চিত হতে পারবেন না যে পরের বার ফলাফলটি তত্ত্বের বিরোধিতা করবে না। অন্যদিকে, আপনি তত্ত্বের ভবিষ্যদ্বাণীগুলির সাথে একমত নয় এমন একটি একক পর্যবেক্ষণ খুঁজে বের করে একটি তত্ত্বকে অস্বীকার করতে পারেন।[13] Stephen Hawking a Brief History of Time; Page:Chapter:1

মনোবিজ্ঞানী কিথ স্ট্যানোভিচ বলেন,

বিজ্ঞান ইতঃপূর্বে যা সত্য বলে প্রমাণ করেছিল, তাকেই প্রতিনিয়ত মিথ্যা প্রমাণ করে চলেছে।[14] Stanovich, Keith E…How to think straight about Psychology. Boston: Pearson Education. Page-106-107

বিজ্ঞান দার্শনিক কার্ল পোপার বলেন,

বৈজ্ঞানিক জ্ঞান সৃষ্টি হয় সত্যের সন্ধান করতে, কিন্তু মনে রাখতে হবে এটি কোন নিশ্চয়তার সন্ধান নয়… মানুষের সকল জ্ঞান ভুলপ্রবণ, তাই অনিশ্চিত।[15] মুজাজ্জাজ নাঈম; মুক্তচিন্তা ও ইসলাম; পৃঃ ৫৬

ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক ড.সামির ওসাকা তার লিখিত, ‘Philosophy of Science: a very short introduction’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন,

ঐতিহাসিকভাবে, বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের অনেক উদাহরণ রয়েছে যা তাদের দিনে অভিজ্ঞতাগতভাবে সফল হয়েছিল কিন্তু পরে মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়েছিল।[16] Samir Okasha; Philosophy of Science: A Very Short Introduction; Page:60

কানাডার দার্শনিক উইলিয়াম নিউটন স্মিথ, তার লিখিত ‘The Rationality Of Science’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন,

যদি আমরা এই সত্যের উপর চিন্তা করি যে অতীতের সমস্ত ভৌত তত্ত্বগুলো তাদের উত্তম দিনে ছিল এবং অবশেষে মিথ্যা হিসেবে প্রত্যাখ্যান হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, একটি হতাশাজনক প্রস্তাবের পক্ষে প্রস্তাবনামূলক সমর্থন রয়েছে যে, যে কোন তত্ত্ব ২০০ বছরের মধ্যে মিথ্যা বলে প্রমাণিত হবে।[17] W H  Newton Smith; The Rationality Of Science; Page: 14 

মার্কিন দার্শনিক Larry Laudan তার লিখিত, ‘Philosophy of Science: Contemporary Readings’ গ্রন্থে বৈজ্ঞানিক যে-সব তত্ত্ব কার্যকর হওয়া সত্ত্বেও পরবর্তী সময়ে ভুল প্রমাণিত হয়েছে এমন কিছু তত্ত্বের সংক্ষিপ্ত তালিকা দিয়েছেন। তালিকাটি নিম্নরূপ;

  • The crystalline spheres of ancient and medieval astronomy. (প্রাচীন এবং মধ্যযুগীয় জ্যোতির্বিদ্যার স্ফটিক গোলক)
  • The humoral theory of medicine. (ঔষধের হাস্যকর তত্ত্ব)
  • The effluvial theory of static electricity. (স্ট্যাটিক বিদ্যুতের প্রবাহ তত্ত্ব)
  • ‘Catastrophist’ geology, with its commitment to a universal (Noachian) deluge. (‘বিপর্যয়বাদী’ ভূতত্ত্ব, একটি সর্বজনীন (নোয়াচিয়ান) প্রতি প্রতিশ্রুতি সহ প্রলয়)
  • The phlogiston theory of chemistry. (রসায়নের ফ্লোজিস্টন তত্ত্ব)
  • The caloric theory of heat. (তাপের ক্যালরি তত্ত্ব)
  • The vibratory theory of heat. (তাপের কম্পনশীল তত্ত্ব)
  • The vital force theories of physiology. (ফিজিওলজির অত্যাবশ্যক শক্তি তত্ত্ব)
  • The electromagnetic aether. (ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ইথার)
  • The optical aether. (অপটিক্যাল ইথার)
  • The theory of circular inertia. (বৃত্তাকার জড়তা তত্ত্ব)
  • Theories of spontaneous generation. (স্বতঃস্ফূর্ত প্রজন্মের তত্ত্ব)[18] Larry Laudan; Philosophy of Science: Contemporary Readings; Page: 224

বিজ্ঞান পরম সত্য না জানানোর আরো একটি অন্যতম কারণ হলো, প্রত্যেকটি পর্যবেক্ষণের পেছনে একজন পর্যবেক্ষক (মানুষ) থাকে। আবার সিদ্ধান্তও গ্রহণ করে কোনো-না-কোনো মানুষ। মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধতা রয়েছে, স্মৃতি-বিস্মৃতির বিভ্রাট ও স্বেচ্ছাচারিতা, সামাজিক চাপ বা কোন গোষ্ঠীর প্রভাব রয়েছে। তাই এগুলো সবকিছুই সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে। এই কারণে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে অনিচ্ছাকৃত ভুল ও ইচ্ছাকৃত ভুল দুটোই থাকতে পারে।[19] Lars-Göran Johansson; philosophy of Science for Scientists; Page: 70

চূড়ান্ত সত্য বা পরম সত্য বলে কিছু নেই?

‘বিজ্ঞান কখনো চূড়ান্ত সত্য বা পরম সত্য জানাতে পারে না’ এই দাবি করার পর কিছু নাস্তিক বলে চূড়ান্ত সত্য বলতে আসলে কিছু নেই। আপনি যদি মনে করেন, চূড়ান্ত সত্য বলতে আসলেই কিছু নেই, এবং এই দাবি যদি সত্য হয় তাহলে এই দাবিটাই তো চূড়ান্ত সত্য। সুতরাং, চূড়ান্ত সত্য বলতে আসলে কিছু নেই এমন দাবিটা ভুল এবং সেলফ ডিফিটিং আর্গুমেন্ট। এটা এমন একটি আত্মঘাতী কথা যে, “বাংলা বাক্যে তিন শব্দের চেয়ে বড় কোনো বাক্য নেই”। এই বাক্যেই কিন্তু তিন শব্দের বেশি শব্দ রয়েছে।

আতিক নামের এক ছেলে দাবি করলো যে, “এই দুনিয়াতে চূড়ান্ত সত্য বলতে আসলেই কিছু নেই”। এই কথা শুনে তার বন্ধু মিসবাহ তাকে জিজ্ঞেস করলো, “আচ্ছা তুমি যে দাবিটি করেছে (এই দুনিয়াতে চূড়ান্ত সত্য বলতে আসলে কিছু নেই) তা কি চূড়ান্তভাবে সত্য নাকি মিথ্যা হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে?” 

আসিফ বললো, “হুম, আমার দাবিটি চূড়ান্তভাবে সত্য”।

তখন মিসবাহ বললো, “যদি এটা চূড়ান্তভাবে সত্য হয় তাহলে চূড়ান্ত সত্যের অস্তিত্ব যে আছে তা এই কথা থেকেই প্রমাণ হয়ে গেল। আর যদি তুমি বলো তোমার দাবিটি (চূড়ান্ত সত্য নেই) মিথ্যা হয় তাহলেও চূড়ান্ত সত্য আছে এটাই সত্য!”

ভালো-মন্দ বা নৈতিকতা নির্ধারণ করতে পারেনা

বিজ্ঞান নৈতিকভাবে নিরপেক্ষ। এখন এর মানে এই নয় যে বিজ্ঞানীদের নৈতিকতা নেই। এর অর্থ হল বিজ্ঞান নৈতিকতার ভিত্তি প্রদান করতে পারে না। ‘স্রষ্টা এবং ব্যক্তি নিরপেক্ষ নৈতিকতা’ লিখাতে আমরা এই বিষয়ে আলোচনা করে এসেছি।

‘কেন ঘটে’? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনা

বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা গুলোর মধ্যে এরো একটি হলো বিজ্ঞান ‘কেন ঘটে’ এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না। কোনো এক কুয়াশা মোড়ানো শীতের সকালে আপনার প্রতিবেশীদের মাঝে একজন আপনার দরজায় কড়া নেড়ে কিছু ভাপা পিঠা দিয়ে গেল। আপনার মনে প্রশ্ন জাগলো, তিনি কেন আপনাকে ভাপা পিঠা দিয়ে গেল? আপনার সামনে থাকা পিঠাগুলো নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার মাধ্যমে আপনি জানতে পারলেন, কত ডিগ্রি সেলসিয়াসে পিঠাগুলো রান্না করা হয়েছে? কি কি উপাদানের সংমিশ্রণে পিঠাগুলো তৈরি করা হয়েছে? ইত্যাদি। এতকিছুর পরেও আপনি এখনো জানতে পারলেন না কেন আপনার প্রতিবেশী আপনাকে পিঠাগুলো দিয়ে গেল? এই প্রশ্নের উত্তর আপনি তখনই জানতে পারবেন যখন আপনার প্রতিবেশীকে প্রশ্ন করা হবে, তিনি কেন আপনার জন্য পিঠা পাঠিয়েছেন? সুতরাং, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মাধ্যমে আমরা ‘কি’ এবং ‘কীভাবে’ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে। কিন্তু ‘কেন’ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনা।

অধিবিদ্যাগত বিষয়ের উত্তর দিতে পারেনা

বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা গুলোর মধ্যে এরো একটি হলো বিজ্ঞান অধিবিদ্যাগত বিষয়ের উত্তর দিতে পারে না। বিজ্ঞান কিছু আধিভৌতিক প্রশ্নের সমাধান করতে পারে যেগুলো এমন যা অভিজ্ঞতামূলকভাবে সমাধান করা যেতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ, বিজ্ঞান মহাবিশ্বের সূচনাকে তার ক্ষেত্রের মাধ্যমে সম্বোধন করতে সক্ষম হয়েছে যা কসমোলজি নামে পরিচিত। তবুও, কিছু বৈধ প্রশ্নের উত্তর বৈজ্ঞানিকভাবে দেওয়া যায় না। এর মধ্যে রয়েছে: ডিডাক্টিভ যুক্তিতে উপসংহার কেন পূর্ববর্তী প্রেমিস থেকে অনুসরণ করা আবশ্যক? স্রষ্টার অস্তিত্ব আছে? আত্মার অস্তিত্ব আছে? কেন কিছুই না থেকে কিছু আছে? (Why is there something rather than nothing?), নৈতিকতা বলতে কিছু আছে? বিজ্ঞান এই প্রশ্নগুলির সমাধান করতে পারে না কারণ বিজ্ঞান এমন জিনিসগুলিকে এড়িয়ে যায় যা শারীরিক বা পর্যবেক্ষণযোগ্য জগতের বাইরে।

অনিবার্য সত্যকে প্রমাণ করতে পারে না

বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা গুলোর মধ্যে এরো একটি হলো বিজ্ঞান অনিবার্য সত্য কে প্রমাণ করতে পারে না।

নিচের যুক্তিটি লক্ষ করুন,

  • মানুষ হয় মরণশীল (আশ্রয় বাক্য)
  • রহিম হয় একজন মানুষ (আশ্রয় বাক্য)
  • সুতরাং রহিম হয় মরণশীল (সিদ্ধান্ত)

এই যুক্তিটিতে সিদ্ধান্ত আশ্রয় বাক্য থেকে অনিবার্যভাবে নিঃসৃত হয়েছে। তাই এটি একটি বৈধ যুক্তি। এখানে আশ্রয় বাক্যের সাথে যেহেতু সিদ্ধান্তের একটা অনিবার্য সম্পর্ক রয়েছে তাই আশ্রয়বাক্য যদি সত্য হয় তাহলে সিদ্ধান্ত সত্য হতে বাধ্য। আশ্রয়বাক্য ও সিদ্ধান্তের এই সম্পর্ক অভিজ্ঞতামূলক কিছুর উপর ভিত্তি করে আসেনি। বরং, এটা আমাদের চিন্তার জগতের উপর ভিত্তি করে এসেছে। সিদ্ধান্ত কেন আশ্রয় বাক্য থেকে আসবে বা যৌক্তিকভাবে কেন এটাই আসতে হবে তা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। তাই বিজ্ঞান আশ্রয় বাক্য আর সিদ্ধান্তের মধ্যে সিদ্ধান্তের ন্যায্যতা দিতে পারবে না। যুক্তি বস্তু জগতের কোনো বিষয় নয়। বরং, বস্তুজগতের ঊর্ধ্বে। এছাড়াও, ২+২= ৪ এগুলো অনিবার্য সত্য। এগুলো পর্যবেক্ষণযোগ্য বা বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত কিছু নয়। আমরা যদি বলি, ২টা আপেল + ২টা আপেল সমান কত? তাহলে ফলাফল আসবে ৪টা আপেল। আবার যদি বলি ২টা বুলচ যোগ ২টা বুলচ সমান কত? তাহলেও ফলাফল আসবে ২টা বুলচ। অথচ বুলচ বলতে আসলে কিছুর অস্তিত্ব আছে কিনা তা আমার জানা নেই। বুলচ জিনিসটা কি সেটা না বুঝলেও আপনি এদের একটার সাথে আরেকটা যোগ করলে যোগফল দুই-ই হবে।  

পিয়ার রিভিউ জার্নাল হলেই কি তা সত্য হতে বাধ্য?

যে কোনো গবেষণা শেষ হলে তা ছাপানোর জন্য জার্নালের কাছে পাঠানো হয়। জার্নাল কর্তৃপক্ষ গবেষণাপত্রটি যাচা-বাছাইয়ের জন্য অন্য গবেষকদের কাছে প্রেরণ করেন। এই প্রক্রিয়াকে পিয়ার রিভিউ বলে। বঙ্গীয় নাস্তিকরা বিজ্ঞানের মতো পিয়ার রিভিউড গবেষণাপত্রকেও নিশ্চিত সত্য মনে করে। বিভিন্ন সময়ে তাদের এমন দাবি করতে শুনেছি যে, কোন গবেষণা পত্র পিয়ার রিভিউড মানেই তা সত্য হতে বাধ্য। কিন্তু বাস্তবতা হলো পিয়ার রিভিউ গবেষণাপত্রগুলোতেও বড় রকমের ভুল থাকে যা রিভিউয়ারদের চোখ এড়িয়ে যায়। পিয়ার রিভিউ গবেষণাপত্রের বিভিন্ন ত্রুটি (মন্থর গতি, ব্যয়বহুলতা, সাবজেক্টিভ রিভিউ প্রক্রিয়া পক্ষপাত, এবং অপব্যবহার) নিয়ে ‘journal of the royal society of medicine’ থেকে ‘Peer review: a flawed process at the heart of science and journals’ শিরোনামে প্রকাশিত এক পত্রে আলোচনা করা হয়েছে। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে,

পিয়ার রিভিউ হল একটি ত্রুটিপূর্ণ প্রক্রিয়া। রিভিউ করার পরেও, সহজেই চিহ্নিত করা যায় এমন ভুল দিয়ে গবেষণাপত্রগুলো পূর্ণ এবং রিভিউয়ের কার্যকারিতার পক্ষেও প্রামাণিত সমর্থন স্বল্প। তা সত্ত্বেও, এটি বিজ্ঞান ও জার্নালের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে কারণ এর কোনো সুস্পষ্ট বিকল্প নেই, এবং বিজ্ঞানী এবং সম্পাদকদের পিয়ার রিভিউতে অবিরত বিশ্বাস রয়েছে।[20] Peer review: a flawed process at the heart of science and journals – PMC (nih.gov)

রসায়নে নোবেল পুরস্কার পাওয়া আমেরিকান বিজ্ঞানী ফ্রান্সিস আর্নল্ড এর একটি গবেষণা পত্র ২০১৯ সালে বিখ্যাত ‘সায়েন্স’ জার্নালে প্রকাশিত হয়। কিন্তু পরবর্তীতে জানা যায় গবেষণাপত্রটি ভুল ছিল। ফ্রান্সিস আর্নল্ড নিজেই টুইট বার্তায় বলেন,

আমার ২০২০ সালের প্রথম কাজ-সম্পর্কিত টুইটের জন্য, আমি ঘোষণা করতে সম্পূর্ণভাবে স্তব্ধ হয়েছি যে আমরা ‘বিটা-ল্যাকটামের এনজাইমেটিক সংশ্লেষণের’ উপর গত বছরের গবেষণাপত্রটি প্রত্যাহার করেছি। কাজটি পুনরুৎপাদনযোগ্য হয়নি। এটা স্বীকার করা বেদনাদায়ক, কিন্তু এটা করা গুরুত্বপূর্ণ। আমি সবার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। এটি জমা দেওয়ার সময় আমি একটু ব্যস্ত ছিলাম, এবং আমার কাজটি ভালোভাবে করতে পারিনি।[21] Nobel Prize-winning scientist Frances Arnold retracts paper – BBC News

শুধু তাই নয়, অর্থের বিনিময়েও বিভিন্ন ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষে গবেষণাপত্র ছাপা হয়। অ্যামেরিকান জনপ্রিয় সংবাদ পত্র, দ্যা ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একটি গবেষণা পত্রে ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথ’ অর্থের বিনিময়ে শুধু অ্যালকোহলের গুণগানই বর্ণনা করেছে। তামাক কোম্পানিগুলোও ধূমপানের গোপন রাখার জন্য গবেষণায় অর্থায়ন করে। অর্থের বিনিময়ে অনুরূপ পক্ষপাত ফার্মাসিউটিক্যাল, রাসায়নিক এবং কীটনাশক কোম্পানিগুলোর জন্যও করে থাকে। প্রতিবেদনটিতে আরো বলা হয়, বিখ্যাত কোকা-কোলা কোম্পানি বিজ্ঞানীদের অর্থ প্রদান করতে চেয়েছিলো যাতে তারা ‘স্থূলতায়’ (Obesity) সোডা বা মিষ্টি পানীয়র পানের ভূমিকা আলোচনা থেকে সড়িয়ে দেয় এবং স্থূলতায়র জন্য ব্যায়ামের অভাবকে দায়ী করে।[22] How a flood of corporate funding can distort NIH research – The Washington Post

এছাড়াও বিজ্ঞানীদের বড় একটি অংশ বস্তুবাদের হাতে জিম্মি। উপরিউক্ত আলোচনা থেকে খুব সহজেই আমরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারি যে, বৈজ্ঞানিক তত্ত্বগুলো কখনোই আমাদের সুনিশ্চিত জ্ঞান প্রদান করতে সক্ষম নয় এবং এর মধ্যে বিভিন্ন রকমের ত্রুটি রয়েছে। বৈজ্ঞানিক যে-কোনো তত্ত্ব পরিবর্তনশীল। আজ যেটা প্রচলিত কাল সেটা পুরোপুরি মিথ্যা প্রমাণিত হতে পারে। এটাই বিজ্ঞানের সৌন্দর্য।

বিজ্ঞানের বিশ্বাস

বিজ্ঞান পূজারি ও নাস্তিকরা অনেক সময়ই দাবি করে যে, বিজ্ঞানে বিশ্বাসের কোন স্থান নেই। কিন্তু ধর্মের ভিত্তি হলো বিশ্বাস। তাই ধর্মের চাইতে বিজ্ঞান বেশি নির্ভরযোগ্য। কিন্তু এসব বিজ্ঞান পূজারি নাস্তিকরা জানেই না যে, বিজ্ঞানের ভিত্তিটা মূলত বিশ্বাসের উপরই দাঁড়িয়ে আছে। আমরা দেখেছি বিজ্ঞান যুক্তি এবং অনুমানের মাধ্যমেই কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছায়। নাস্তিক বিজ্ঞান দার্শনিক গ্লেন বরচার্ড The Ten Assumptions of Science Towards a New Scinetific Worldview’ গ্রন্থে ১০টি বৈজ্ঞানিক অনুমান নিয়ে আলোচনা করেন যেগুলো বিজ্ঞান চোখ বন্ধ করে মেনে নেয় প্রমাণ ছাড়াই। অনুমানগুলো হলো, MATERIALISM, CAUSALITY, UNCERTAINTY, INSEPARABILITY, CONSERVATION, COMPLEMENTARITY, IRREVERSIBILITY, INFINITY, RELATIVISM, INTERCONNECTION.[23] Glenn Borchardt; The ten assumptions of science: Toward a new scientific worldview.

আইনস্টাইন এর মতে,

মহাবিশ্বের যে আসলেই অস্তিত্ব আছে, এমন বিশ্বাস সকল প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ভিত্তি।[24] Glenn Borchardt; The ten assumptions of science: Toward a new scientific worldview; Chapter;1

বিজ্ঞান লেখিকা মারগারেট ভার্থেইম এর মতে,

আমরা সবাই কিছু-না-কিছু বিশ্বাস করি এবং বিজ্ঞান নিজেও কিন্তু একগাদা বিশ্বাসের উপর দাঁড়িয়ে আছে।[25] ডা.রাফান আহমেদ; অবিশ্বাসী কাঠগড়ায়; পৃঃ ৩৪

স্কেপটিক ম্যাগাজিনের প্রতিষ্ঠাতা প্রকাশক ও বেস্ট সেলিং লেখক, ডঃ মাইকেল শেরমার (নাস্তিক) তার ব্যক্তিগত ওয়েবসাইটে ‘What I Believe But Cannot Prove’ শিরোনামের লিখাতে বলেন,

আমি বিশ্বাস করি কিন্তু প্রমাণ করতে পারি না যে বাস্তবতা বিদ্যমান এবং বিজ্ঞান এটি বোঝার সর্বোত্তম পদ্ধতি; কোন ঈশ্বর নেই; মহাবিশ্ব নির্ধারিত কিন্তু আমরা স্বাধীন; নৈতিকতা মানুষ এবং মানব সম্প্রদায়ের একটি অভিযোজিত বৈশিষ্ট্য হিসাবে বিকশিত হয়েছে; এবং শেষ পর্যন্ত সমস্ত অস্তিত্ব বিজ্ঞানের মাধ্যমে ব্যাখ্যাযোগ্য।[26] What I Believe But Cannot Prove » Michael Shermer

দার্শনিক, আর.জি. কলিংউড এর মতে,

বিজ্ঞান অনুমানের উপর ভিত্তি করে। এটা বলার সমতুল্য যে বিজ্ঞান ‘তথ্য’ এর পরিবর্তে ‘বিশ্বাসের’ উপর ভিত্তি করে।[27] Glenn Borchardt; The ten assumptions of science: Toward a new scientific worldview; Page: 119

ব্রিটিশ জনপ্রিয় বিজ্ঞান লেখক জিম ব্যাগট এর মতে,

অধিবিদ্যা ছাড়া একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব তৈরি করা অসম্ভব বলে প্রমাণিত হয়, প্রথমে কিছু জিনিস অনুমান না করে আমরা আসলে প্রমাণ করতে পারি না, যেমন একটি বস্তুনিষ্ঠ বাস্তবতার অস্তিত্ব এবং আমরা বিশ্বাস করি অদৃশ্য সত্তা এতে বিদ্যমান। [28] Post-empirical science is an oxymoron, and it is dangerous | Aeon Essays

ব্রিটিশ জীববিজ্ঞানী, এবং প্যারাসাইকোলজি গবেষক, এবং লেখক রুপার্ট শেলড্রেক, বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন এমন ১০টি মূল বিশ্বাসের তালিকা দিয়েছে। তালিকাটি নিন্মরুপ,

  • সবকিছুই যান্ত্রিক। এমনকি মানুষও মেশিন।
  • সমস্ত বস্তু অচেতন। এর কোনো অভ্যন্তরীণ জীবন বা বিষয়গততা বা দৃষ্টিভঙ্গি নেই। এমনকি মানুষের চেতনাও মস্তিষ্কের বস্তুগত কার্যকলাপ দ্বারা উৎপাদিত একটি বিভ্রম।
  • পদার্থ এবং শক্তির মোট পরিমাণ সবসময় একই থাকে (বিগ ব্যাং বাদে, তখন মহাবিশ্বের সমস্ত পদার্থ এবং শক্তি আকস্মিক উদ্ভব হয়েছিল)।
  • প্রকৃতির নিয়ম স্থির। তারা শুরুতে যেমন ছিল আজও তেমনি আছে এবং চিরকাল একই থাকবে।
  • প্রকৃতি উদ্দেশ্যহীন, এবং বিবর্তনের কোনো লক্ষ্য বা দিক নেই।
  • সমস্ত জৈবিক উত্তরাধিকার বস্তুগত, জেনেটিক উপাদান, ডিএনএ এবং অন্যান্য উপাদান কাঠামোতে বহন করা হয়।
  • মন মাথার ভিতরে থাকে এবং মস্তিষ্কের কার্যকলাপ ছাড়া কিছুই নয়। আপনি যখন একটি গাছের দিকে তাকান, তখন আপনি যে গাছটির প্রতিচ্ছবি দেখছেন সেটি “বাইরে” নয়, যেখানে মনে হয় আপনার মস্তিষ্কের ভিতরে।
  • স্মৃতি মস্তিষ্কে বস্তুগত চিহ্ন হিসাবে সংরক্ষণ করা হয় এবং মৃত্যুর সময় মুছে ফেলা হয়।
  • টেলিপ্যাথির মত অব্যক্ত ঘটনাগুলি অলীক।
  • যান্ত্রিক ওষুধই একমাত্র প্রকার যা সত্যিই কাজ করে।[29] Rupert Sheldrake; Setting Science Free From Materialism

বিজ্ঞান কি আল্লাহর অস্তিত্ব বাতিল প্রমাণ করেছে? 

বিজ্ঞানবাদী, মুক্তমনা, নাস্তিকরা, দাবি করে স্রষ্টা বলতে যদি কিছু আসলেই থাকতো তাহলে বিজ্ঞান অবশ্যই এতো দিনে স্রষ্টাকে খুঁজে পেত। বিজ্ঞান যেহেতু এখনো স্রষ্টাকে খুঁজে পাইনি তাই স্রষ্টা বলতে কিছু থাকতে পারে না। কিন্তু বিজ্ঞানের চোখে কোন কিছু ধরা পড়েনি তাই বলে তার অস্তিত্ব নেই এমন চিন্তাধারার সাথে কি বিজ্ঞানের কোন সম্পর্ক আছে? নাস্তিক নিউরোসাইন্টিস্ট রেমন্ড ট্যালিস এর মতে,

যেহেতু বিজ্ঞানের চোখে ধরা পড়েনি, তাই এর কোন অস্তিত্ব নেই এমন মানসিকতার সাথে বিজ্ঞানের কোন সম্পর্ক নেই। বরং, এমন কথা তারাই বলে যারা প্রাকৃতিক বিজ্ঞানকে সর্বশক্তিমান বানিয়ে ফেলেছে। এটা বিজ্ঞানবাদী আচরণ।[30] ডা.রাফান আহমেদ; হোমো স্যাপিয়েনস; পৃঃ ১৪৩

ইতোমধ্যেই আমরা জেনেছি বিজ্ঞান কি, বিজ্ঞানের আলোচনার বিষয় কি, এবং বিজ্ঞান কীভাবে কাজ করে। বিজ্ঞান শুধু মাত্র আমাদের এই বাহ্যিক জগতের যা কিছু পর্যবেক্ষণযোগ্য ও পরিক্ষণযোগ্য সেসব বিষয় নিয়েই কাজ করে। বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে দেখেছি বিজ্ঞানের সিদ্ধান্তগুলো চিরস্থায়ী বা সুনিশ্চিত নয়। সকল প্রশ্নের জবাবও বিজ্ঞান দিতে পারে না। এমন অনিশ্চিত পদ্ধতির উপর নির্ভর করে যদি কেউ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে স্রষ্টা বলতে আদতে কিছু নেই! তাহলে কি এই সিদ্ধান্তকে যৌক্তিক বলা যায়? 

স্রষ্টাকে বিজ্ঞানের চোখে দেখতে চাওয়ার অর্থ হলো, স্রষ্টাকে সরাসরি পর্যবেক্ষণ করা। আমরা জানি স্রষ্টা মহাবিশ্ব বা এই প্রকৃতির অংশ নয়। বরং, স্রষ্টা হলো অতিপ্রাকৃত এক সত্তা। কিন্তু বিজ্ঞান কি কখনোই অতিপ্রাকৃতক বিষয় নিয়ে আলোচনা করে? অতিপ্রাকৃতক বিষয় দূরের কথা, বিজ্ঞান কি এই প্রকৃতির সব কিছুর ব্যাখ্যা প্রদান করতে পারে? বিজ্ঞানের এত অগ্রগতি সত্ত্বেও, মানব সভ্যতার এতো উন্নতি হওয়ার পরেও এই মহাবিশ্বের মাত্র ৫% এর কিছু অংশ বিজ্ঞান আমাদের জানাতে পেরেছে।[31] How did we get here? – NASA Science

বিজ্ঞান এবং মহাকাশ লেখক ক্লারা মস্কোভিটজ এর মতে,

বর্তমানে দেখা যায় এমন সমস্ত নক্ষত্র, গ্রহ এবং ছায়াপথ মহাবিশ্বের মাত্র ৪ শতাংশ। বাকি ৯৬ শতাংশ জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা দেখতে, শনাক্ত করতে বা এমনকি বুঝতেও পারে না এমন জিনিস দিয়ে তৈরি। এই রহস্যময় পদার্থগুলোকে বলা হয় ডার্ক এনার্জি এবং ডার্ক ম্যাটার।[32] What’s 96 Percent of the Universe Made Of? Astronomers Don’t Know | Space

ডার্ক এনার্জির ধারণা আবিষ্কার করার জন্য ২০১১ সালে নোবেল পুরস্কার পাওয়া টিমের সদস্য প্রফেসর অ্যালেক্স ফিলিপ্নেনকো (নাস্তিক) RT News’কে দেওয়ার এক সাক্ষাৎকারে বলেন,

বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বের মাত্র ৪ শতাংশ সম্পর্কে জানেন – অর্থাৎ, আমরা মহাবিশ্বের ৪ শতাংশের প্রকৃতি বেশ ভালোভাবে বুঝতে পারি। মহাবিশ্বের ৯৬ শতাংশ ডার্ক ম্যাটার এবং ডার্ক এনার্জি দিয়ে তৈরি। এবং যদিও আমরা জানি যে তারা উপস্থিত রয়েছে আমরা জানি না তাদের বিস্তারিত বৈশিষ্ট্যগুলি কী বা কেন তারা সেখানে রয়েছে। বা ঠিক কি হচ্ছে।[33] ‘Scientists only understand 4% of universe’ — RT World News

এই মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের জানার চেয়ে অজানাই বেশি। আমরা ডার্ক এনার্জি বা অন্ধকার শক্তি (৬৮%) এবং ডার্ক ম্যাটার (২৭%) আছে তা জানি। এই ডার্ক মেটার এবং ডার্ক এনার্জি ছাড়া পৃথিবীর সমস্ত কিছু, আমাদের পর্যবেক্ষণ করা সমস্ত কিছু, সমস্ত স্বাভাবিক পদার্থ, মহাবিশ্বের ৫% এরও কম। যেখানে বিজ্ঞান নিজেই মহাবিশ্বের সবকিছুর ব্যাখ্যা করতে পারে না, জানতে পারেনা, সেখানে বিজ্ঞান স্রষ্টাকে খুঁজে পাইনি তাই স্রষ্টা নেই এমন দাবি কি আদৌ যুক্তিযুক্ত মনে হয়?

স্রষ্টার অস্তিত্ব বিষয়ক অধ্যায়ে আমরা দেখেছি সংজ্ঞা অনুযায়ী স্রষ্টা এমন এক সত্তা যিনি এই বস্তুজগতের বাহিরের এক অতিপ্রাকৃতিক সত্তা। বিজ্ঞান শুধু মাত্র পর্যবেক্ষণ ও পরিক্ষণের মাধ্যমে এই বাহ্যিক জগৎ বা বস্তুজগতের ব্যাখ্যা প্রধানে সীমাবদ্ধ। তাই অতিপ্রাকৃতিক কোন সত্তার অস্তিত্ব আছে নাকি নেই এই বিষয়ে বিজ্ঞানের ভূমিকা হলো নিরপেক্ষ। বিজ্ঞান এই বিষয়ে কিছুই বলে না। ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেস এর বিজ্ঞানীদের মতে,

বিজ্ঞান প্রাকৃতিক জগৎ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের একটি উপায়। প্রাকৃতিক জগৎ সম্পর্কে জাগতিক ব্যাখ্যা প্রদানে এটি সীমাবদ্ধ। বিজ্ঞান অতিপ্রাকৃত সম্পর্কে কিছুই বলতে পারে না। স্রষ্টা আছেন নাকি নেই- এ প্রশ্নের ব্যাপারে বিজ্ঞান নিরপেক্ষ।[34] Teaching About Evolution and the Nature of Science. Page: 58.

প্রফেসর অ্যালেক্স ফিলিপ্নেনকো (নাস্তিক) RT News’কে দেওয়া একই সাক্ষাৎকারে আরো বলেন,

আমি শুধু মাত্র একজন বিজ্ঞানীর দৃষ্টিকোণ থেকে, বুদ্ধিবৃত্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে মহাবিশ্ব নিয়ে আলোচনা করতে যাচ্ছি। আমি আধ্যাত্মিক ঈশ্বর বা ব্যক্তিগত ঈশ্বর বা মহাবিশ্বের একটি উদ্দেশ্য আছে কিনা তা নিয়ে কথা বলতে যাচ্ছি না – এইগুলি এমন প্রশ্ন যা বিজ্ঞানীরা সমাধান করতে পারেন না। আমার নিজের বিশ্বাস হল যে একবার আপনার কাছে পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম থাকলে মহাবিশ্ব তার নিজের মতো চলতে থাকে। এমনকি এমনও হতে পারে যে, মহাবিশ্বকে প্রথম থেকে শুরু করার জন্য আপনার যা দরকার তা হল পদার্থবিদ্যার নিয়ম – “বিগ ব্যাং”। RT: তাহলে পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রের উৎপত্তি কী? অ্যালেক্স ফিলিপ্নেনকো: এটা একটা বড় প্রশ্ন – পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রের উৎপত্তি কী? আমি জানি না এটি এমন একটি প্রশ্ন যা বিজ্ঞান উত্তর দিতে পারে না।

জীববিজ্ঞানী স্কট টড বিখ্যাত সায়েন্স জার্নাল Nature-এ প্রকাশিত এক চিঠিতে বলেন,

এমনকি যদি সমস্ত তথ্য উপাত্ত একজন বুদ্ধিমান ডিজাইনারকে (স্রষ্টা) নির্দেশ করে, তবে এই ধরনের অনুমান বিজ্ঞান থেকে বাদ দেওয়া হয় কারণ এটি প্রাকৃতিক (বিজ্ঞানের বিষয়) নয়। অবশ্যই, বিজ্ঞানী, একজন ব্যক্তি হিসাবে, এমন একটি বাস্তবতাকে আলিঙ্গন করতে স্বাধীন যা প্রকৃতিবাদকে অতিক্রম করে।[35] A view from Kansas on that evolution debate | Nature

স্রষ্টার অস্তিত্ব বিষয়ক আলোচনা বিজ্ঞানের অন্তভূক্ত নয়, এটি বিজ্ঞানের আওয়তার বাহিরে। বিজ্ঞান স্রষ্টার অস্তিত্বের প্রমাণ পেলেও তা প্রত্যাখ্যান করবে। তাই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সাহায্যে স্রষ্টার অস্তিত্ব খোঁজার চেষ্টা করা নিছক সময় নষ্ট ছাড়া আর কিছুই নয়। স্রষ্টার অস্তিত্ব বা অতিপ্রাকৃত সত্তার অস্তিত্বের আলোচনা অধিবিদ্যার বিষয় এবং বিজ্ঞান কেবল বস্তুজগতের পর্যবেক্ষণযোগ্য বিষয়ের ব্যাখ্যা প্রদানে সীমাবদ্ধ, বা বিজ্ঞানের কর্মপরিধি এতটুকু। সুতরাং, বিজ্ঞান কখনোই স্রষ্টার অস্তিত্ব প্রমাণ বা বাতিল প্রমাণ করতে পারে না।

বিজ্ঞানের দর্শন সম্পর্কে এতটুকু লেখা যদি আপনি একটানা পড়ে থাকেন তাহলে আমার লেখার মান যা-ই হোক,  আপনি যে অত্যন্ত উঁচু মানের একজন ধৈর্যশীল পাঠক তা নিশ্চিত। আপনাকে একরাশ শুভেচ্ছা। 

References

References
1 Samir Okasha (2016), Philosophy of Science: A very short introduction (Oxford University press,2nd edition) Page; 115
2 SCIENCE | English meaning – Cambridge Dictionary
3 Teaching About Evolution and the Nature of Science. Page; 58
4 রাসেল, বি. (১৯৩৫) রিলিজিয়ন অ্যান্ড সায়েন্স। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, পৃষ্ঠা; ৮
5 Ecology: Concepts and Applications. Page; 511
6 James Ladyman; Understanding Philosophy of Science. Page: 4
7 Samin Okasha; Philosophy of Science: A Very Short Introduction; Page; 11
8 The Routledge Companion to Philosophy of Science; Page: 137-38
9 Samir Okasha (2016), Philosophy of science: A very short introduction (Oxford university press, 2nd edition) Page: 115
10 জাফর ইকবাল;আরো একটু খানি বিজ্ঞান; পৃষ্টা নং-১৭
11 Quote by Freeman John Dyson: “The public has a distorted view of science beca…” (goodreads.com)
12 Realism and Theory Change in Science (Stanford Encyclopedia of Philosophy)
13 Stephen Hawking a Brief History of Time; Page:Chapter:1
14 Stanovich, Keith E…How to think straight about Psychology. Boston: Pearson Education. Page-106-107
15 মুজাজ্জাজ নাঈম; মুক্তচিন্তা ও ইসলাম; পৃঃ ৫৬
16 Samir Okasha; Philosophy of Science: A Very Short Introduction; Page:60
17 W H  Newton Smith; The Rationality Of Science; Page: 14 
18 Larry Laudan; Philosophy of Science: Contemporary Readings; Page: 224
19 Lars-Göran Johansson; philosophy of Science for Scientists; Page: 70
20 Peer review: a flawed process at the heart of science and journals – PMC (nih.gov)
21 Nobel Prize-winning scientist Frances Arnold retracts paper – BBC News
22 How a flood of corporate funding can distort NIH research – The Washington Post
23 Glenn Borchardt; The ten assumptions of science: Toward a new scientific worldview.
24 Glenn Borchardt; The ten assumptions of science: Toward a new scientific worldview; Chapter;1
25 ডা.রাফান আহমেদ; অবিশ্বাসী কাঠগড়ায়; পৃঃ ৩৪
26 What I Believe But Cannot Prove » Michael Shermer
27 Glenn Borchardt; The ten assumptions of science: Toward a new scientific worldview; Page: 119
28 Post-empirical science is an oxymoron, and it is dangerous | Aeon Essays
29 Rupert Sheldrake; Setting Science Free From Materialism
30 ডা.রাফান আহমেদ; হোমো স্যাপিয়েনস; পৃঃ ১৪৩
31 How did we get here? – NASA Science
32 What’s 96 Percent of the Universe Made Of? Astronomers Don’t Know | Space
33 ‘Scientists only understand 4% of universe’ — RT World News
34 Teaching About Evolution and the Nature of Science. Page: 58.
35 A view from Kansas on that evolution debate | Nature

Sazzatul Mowla Shanto

As-salamu alaykum. I'm Sazzatul mowla Shanto. Try to learn and write about theology and philosophy.

4 Comments

  1. সম্পূর্ণ পড়েছি, তবে দুধ-আনারস এই উদাহরণটুকু মুছে দিলে ভালো হয়।
    কারণ শরীরে দুধ-আনারসের ইফেক্ট ইন্ডাক্টিভ পদ্ধতিতে বের করা হয়। এখানে দুধ-আনারসের উপাদানগুলো কিভাবে শরীরের উপাদানের সাথে ক্রিয়া বিক্রিয়া করছে তারই ফলাফল। যেহেতু সবার শরীরের কাঠামো একই তাই দুধ-আনারসের ক্রিয়া বিক্রিয়া সবার ক্ষেত্রে একই ঘটবে। যেমন- আমরা ইন্ডাক্টিভ পদ্ধতিতে পরীক্ষা না করেও জানি বিষ খেলে মানুষ মারা যায়। যদি একজন মানুষের উপরেও বিষের প্রয়োগ করে পরীক্ষা করা হয় তাহলেও স্পষ্ট বুঝা যাবে যে বিষের উপাদান শরীরের উপাদানের সাথে ক্রিয়া বিক্রিয়া করে মৃত্যু ঘটাতে পারে। কিন্তু আমরা কী বলতে পারবো যে, বিষ খেলে অনেকের মৃত্যু নাও হতে পারে? সাধারণ্যে এই মতবাদ বিশ্বাস করাতে পারলে মানুষ মরতেই থাকবে।

    এছাড়া বাকি আলোচনা যথাযথ মনে হয়েছে। খুবই ভালো লেগেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button