ফসিল জীবাশ্মঃ পাথরের গল্প
বিবর্তনবাদ
ফসিল
মূলত, ল্যাটিন শব্দ ফসাস (fossus) (অর্থ – উত্তোলন করা) থেকে ‘ফসিল’ শব্দটি উদ্ভূত হয়েছে। বৈশ্বিকভাবে জীবাশ্মের ন্যায় জটিল বিষয়ের তথ্য সংরক্ষণকে ফসিল রেকর্ড নামে অভিহিত করা হয়। আবিষ্কৃত কিংবা অনাবিষ্কৃত সমুদয় জীবাশ্মের সংখ্যা, তাদের অবস্থান, শিলার বিন্যাস এবং পাললিক শিলার স্তর – এগুলোকে একত্রে ফসিল রেকর্ড বলা হয়। এই রেকর্ডের বিশ্লেষণ পৃথিবীর জীবনচক্রের ইতিহাস তুলে ধরার সেরা উপায় হিসেবে বিবেচিত। ভৌগোলিক সময়ের মানদণ্ডে জীবাশ্মের গঠন, বয়স এবং বিবর্তনের ধারায় সম্পৃক্ততা জীবাশ্মবিজ্ঞানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
বেশিরভাগ জীবাশ্ম তৈরী হয় পানির নিচে। তাই স্থলচর অপেক্ষা জলচর প্রাণীর ফসিল বেশি পাওয়া যায়। এজন্যই অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় ডাইনােসরের জীবাশ্ম পাওয়া গেছে কম। অনেক ডাইনােসর প্রজাতি ফসিল হিসেবে রেখে গেছে কিছু দাঁত বা পায়ের হাড়। চামড়া বা অন্যান্য নরম মাংসের ফসিল খুবই বিরল। তাই বলা যায় এই জীবাশ্মের রেকর্ড অসম্পূর্ণ আর ডাইনােসরের গঠনের অনেক কিছুই আমাদের অজানা। তারপরও বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করে যাচ্ছেন। প্রতি বছরই নতুন নতুন জীবাশ্ম আবিষ্কৃত হচ্ছে আর আমরাও ডাইনােসর সম্পর্কে নতুন নতুন তথ্য জানতে পারছি। ডাইনােসরের জীবাশ্ম সাধারণত পাথর দিয়ে ঘেরা থাকে। খনন করার সময় এই পাথরকে সতর্কতার সাথে আলাদা করা। হয়। অনেক সময় জীবাশ্মের তুলনায় আশেপাশের পাথর নরম থাকে। আবার মরভূমিতে যে সকল জীবাশ্ম পাওয়া যায় তা তুলির সাহায্যে উপরের বালু সরিয়েই সংগ্রহ করা হয়। কিন্তু এই জীবাশ্ম সংগ্রহ খুবই সময়সাধ্য এবং ধৈর্য্যের কাজ। বিজ্ঞানীরা যেসব জীবাশ্ম উত্তোলন করেন সেগুলােকে বেশ কিছু ভাগে ভাগ করেন। যেমন-
প্রকৃত জীবাশ্মঃ প্রত্নতত্ত্ববিদ ডাইনােসরের হাড় বা দাঁত খনন করে বের করে আনেন। তা হল প্রকৃত জীবাশ্ম। এই জীবাশ্ম যে প্রক্রিয়ায় তৈরী হয় তাকে বলে খনিজীকরণ বা (Mineralization)। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে মাটিতে থাকা হাড়ের মধ্যে খনিজ পদার্থ জমে একে শক্ত ও কঠিন করে তােলে। ক্রিটেশিয়াস যুগের বৃহৎ শিকারী টিরেনােসরাসের দাঁত ও চোয়ালের হাড় এই প্রক্রিয়াই সংরক্ষিত ছিল।
ছাঁচ জীবাশ্মঃ অনেক উদ্ভিদ ও প্রাণীর জীবদেহ পুরােপুরি ফসিলে পরিণত হওয়ার আগেই নষ্ট হয়ে যায়। তবে কিছু ক্ষেত্রে এদের চারপাশের কাদা এত দ্রুত শক্ত হয়ে যায় যে তাতে ঐ জীবদেহের ছাপ থেকে যায়। যখন ঐ কাদা পাথরে পরিণত হয়তখন হয়ত জীবের কোনাে অংশ ওখানে থাকে না কিন্তু পাথরে ঐ অংশের ন্যায় গর্ত হয়ে থাকে। জুরাসিক যুগের কিছু সামুদ্রিক প্রাণীর এরূপ জীবাশ্ম পাওয়া গেছে।
নমুনা জীবাশ্মঃ কিছু জীবাশ্মে প্রাণীর দেহের কোনাে অংশ বা ছাঁচ থাকে না, বরং প্রাণীটা যে এখানে ছিল তার প্রমাণ থেকে যায়। অনেকটা পাখি উড়ে চলে যায় রেখে যায় পালক ধরণের। এই জীবাশ্মগুলাে বিজ্ঞানীদের কাছে খুবই আগ্রহের বস্তু। এর মাধ্যমে প্রাণীর জীবন আচরণ সম্পর্কে জানা যায়। ডাইনােসরের নমুনা জীবাশ্মের মধ্যে আছে এর পায়ের ছাপ, বাসা, থাকার গর্ত, এমনকি পাথরে পরিণত হওয়া ডাইনােসরের মল (এদের বলা হয় coprolites)।
সম্পূর্ণ জীবাশ্মঃ হ্রদ বা সমুদ্রের তলদেশে ধীরে ধীরে পলি জমার মাধ্যমে অনেক সময় জলজ প্রাণী বিশেষ করে মাছের প্রায় সম্পূর্ণ জীবাশ্ম পাওয়া যায়। এতে হাড় ও পাখনার সাথে সাথে ত্বকেরও জীবাশ্ম থাকে।
বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন রকম ডেটিং মেথড ব্যবহার করে ফসিলের বয়স অনুমান করে থাকেন। বিজ্ঞানীদের ধারণা পৃথিবীতে যতরকম প্রাণের আবির্ভাব হয়েছিল তার প্রায় ৯৯% বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এদের অতি নগণ্য সংখ্যকের ফসিল পাওয়া গেছে। ফসিলবিদগণ বিভিন্ন নিয়ামক উল্লেখ করেছেন, যার ফলে ফসিল খুবই অল্প পরিমাণে গঠিত হয়। (১) এই ফসিলকেই বিবর্তনের এবং এক প্রাণীর সঙ্গে অন্যান্য প্রানীর জৈবিক সম্পর্কের অত্যন্ত শক্তিশালী প্রমাণ হিসেবে ধরা হয়। আসলেই কি তাই? প্রকৃতপক্ষে তা সম্ভব নয়, যেমন ধরুন একই স্থানে দুটো মানুষের ফসিল পাওয়া গেল সেক্ষেত্রে কার্বন ডেটিং এর মাধ্যমে জানা গেল একটি ফসিল অন্যটির তুলনায় ১৫ বছরের বড় সেক্ষেত্রে বয়স্ক ফসিল টি কি ছোট ফসিলের পিতামাতার কেউ ছিলেন? এটা কিন্তু ফসিলের মাধ্যমে জানা অসম্ভব। এটি জানতে হলে অন্যান্য স্বাধীন কিছু মেকানিজম যেমন জিনোম সিকুয়েন্সিং কিংবা আণবিক পরীক্ষণ প্রয়োগ করতে হবে।
1978 সালে, নিউইয়র্কের আমেরিকান মিউজিয়াম অফ ন্যাচারাল হিস্ট্রির জীবাশ্ম বিশেষজ্ঞ গ্যারেথ নেলসন লিখেছেন ” কেউ যদি মনে করে থাকে যে জীবাশ্মের কাছে যাবে এবং জীবাশ্ম দ্বারা পরীক্ষিতভাবে কোনো প্রজাতি কিংবা গণের বংশদ্ভূত পূর্বপুরুষ পুনরুদ্ধার করে ফেলবে তবে তা কেবলই ক্ষতিকারক বিভ্রম মাত্র। ” (২)
ন্যাচার জার্নালের সিনিয়র এডিটর এবং বিখ্যাত জীবাশ্মবিদ বলেন, ” জীবাশ্ম তার জন্ম সনদ নিয়ে সমাধিস্থ হয়না” অর্থাৎ আপনি চাইলেই কোনো ফসিল কে এটা এই ফসিল কিংবা সেই ফসিল বলে দাবি করতে পারবেন না। (৩)
তিনি আরও বলেন, ফসিল-প্রমাণ কোনো নিরবচ্ছিন্ন বাক্য নয়, খণ্ডবাক্যও নয়; এমনকি শব্দও নয়। বরং ফসিলকে তিনি তুলনা করেছেন কিছু দুষ্প্রাপ্য যতিচিহ্নের সাথে! বিজ্ঞানীরা নিজেদের মনোমতো এই যতিচিহ্নগুলি দিয়ে বাক্য সাজায়; অর্থাৎ প্রাণের ইতিহাস রচনা করে। কিন্তু কারও পক্ষেই ফসিল দিয়ে নিশ্চয়তার সাথে বলা সম্ভব না—অমুক থেকে তমুক এসেছে, যা বলা হয় সবই অনুমানমাত্র। (৪)
রেফারেন্সঃ
1.Michael J. Benton & David A. T. Harper (2009), Introduction to Paleobiology & the Fossil Record (UK: Wiley Blackwell) p. 70 – 72
2.From a presentation by Gareth Nelson in 1969 to the American Museum of Natural History, quoted in David M. Williams and Malte C. Ebach, “The Reform of Palaeontology and the Rise of Biogeography — 25 Years after ‘Ontogeny, Phylogeny, Palaeontology and the Biogenetic Law’ (Nelson, 1978),” Journal of Biogeography 31 (2004): 709.
3.Henry Gee, In Search of Deep Time (New York: Free Press, 1999), 23, 32, 116-117.
4.Henry Gee (2013), The Accidental Species: Misunderstandings of Human Evolution (University of Chicago Press) p. 15-16