আদম (আঃ) কি মিথ্যা কথা বলেছিলেন? নবীগণের নিষ্পাপত্ব
নবীগণের নিষ্পাপত্ব
প্রশ্ন:—
মুসলিম দায়ীগণ দাবি করে থাকেন যে সমস্ত নবী-রাসুলগণ নিষ্পাপ ছিলো। কিন্তু আমরা ইসলামী শারীয়ার দ্বিতীয় উৎস হাদীস (তিরমিজী/৩০৭৬) থেকে পাই ইসলামের প্রথম মানব আদম (আঃ) আল্লাহর কাছে অনুরোধ করে তার জীবনকাল থেকে পরবর্তী এক বংশোদ্ভূত দাউদ (আঃ)কে চল্লিশ বছর দিয়ে দিয়েছিলো। অতপর মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এলে সে ওই বিষয়টি অস্বীকার করে তার বাকি চল্লিশ বছর দাবি করে বসে! সে দাবি করে, সে কিনা তার জীবনকাল থেকে কাউকে কোনো অংশই দেয়নি! সে কিনা এমন কিছু করেইনি! তাহলে কি এ থেকে প্রমাণিত হয়না যে, নবীগণও পাপ করতেন?
উত্তর:—
সমস্ত প্রশংসা মহান আল্লাহর, যিনি এ ব্যাপারে সত্য জানার এবং সত্য জানানোর তাওফীক দান করেছেন। আলহামদুলিল্লাহ।
ইসলাম বিরোধী, বিশেষত খ্রিষ্টান মিশনারিরা ধর্ম প্রচার এবং তাদের ধর্মকে ‘শ্রেষ্ঠ’ বলে প্রচার করার জন্য সাধারণত এমন একটা দাবি আওড়ে থাকে। সকল ইসলামবিরোধীদের মূল ও শেকড় একই বলে নাস্তিক ব্লগারদেরও দেখা যায় খ্রিষ্টান মিশনারিদের থেকে কপি পেস্ট করে এমন বুলি ছড়াতে। খ্রিষ্ট বিশ্বাসীদের এমন প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর কারণ হচ্ছে তাদের বিশ্বাসে যে কোনো ভাববাদী/নবীগনই পাপের অধীন হতে পারেন। অর্থাৎ যেকোনো ভাববাদীই পাপ করতে পারেন। খোদ বাইবেলই তার স্বাক্ষী। বক্ষ্যমান বাইবেল আদম (আঃ), নূহ(আঃ), ইবরাহীম(আঃ),দাউদ (আঃ), সুলাইমান (আঃ) আলাইহিমুস সালাম সহ আরো বহু আম্বিয়া/ভাববাদীদেরকেই ‘পাপী/দোষী/গুনাহগার’ বলেছে। এখন, এমতাবস্থায় যদি ইসলামের নবীগনকে ‘পাপী’ সাব্যস্ত (!) না করতে পারে, তাহলে তো বাইবেল বা খ্রিষ্টধর্মের ‘শ্রেষ্ঠত্ব’ প্রমাণিত হলোনা! তাই সত্যকে রুখে দিতে তাদের এহেন তোড়জোড়।
বাইবেলে ভাববাদীই দের পাপী বলার প্রমাণঃ বাইবেল/রোমীয়/৫/১৪ ; বাইবেল/আদিপুস্তক/৯/২০-২৭; বাইবেল/আদিপুস্তক/১২/১১-২০ ও আদিপুস্তক/২০/১-১৮ ; বাইবেল/শমুয়েল-২/১১/১-২৭; বাইবেল/রাজাবলি-১ /১১/৪-৯;
এটাতো গেল খ্রিষ্টান মিশনারিদের উদ্দেশ্য।
কিন্তু নাস্তিকরা? তারা কিসের জন্যে এহেন অপপ্রচার করে থাকে? তাদেরও কি কোনো ধর্মগ্রন্থ রয়েছে যাকে শ্রেষ্ঠ বলে প্রমাণ করা দরকার? নাকি এর দ্বারা তারা খ্রিষ্টানদের মনোরঞ্জন করতে চাচ্ছে যেন সে দেশের ফ্রি ভিসার জন্য একটা ‘নেক নজর’ পাওয়া যায়!?
প্রথমেই আমরা নবীগণের নিষ্পাপত্ব / পাপী হওয়া নিয়ে আমাদের আকীদা কী তা দেখে নিব।
এ বিষয়ে সুমহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তাঁর কিতাবে উল্লেখ করেছেন,
”وَهَبۡنَا لَهٗۤ اِسۡحٰقَ وَ یَعۡقُوۡبَ ؕ کُلًّا هَدَیۡنَا ۚ وَ نُوۡحًا هَدَیۡنَا مِنۡ قَبۡلُ وَ مِنۡ ذُرِّیَّتِهٖ دَاوٗدَ وَ سُلَیۡمٰنَ وَ اَیُّوۡبَ وَ یُوۡسُفَ وَ مُوۡسٰی وَ هٰرُوۡنَ ؕ وَ کَذٰلِکَ نَجۡزِی الۡمُحۡسِنِیۡنَ. وَزَکَرِیَّا وَ یَحۡیٰی وَ عِیۡسٰی وَ اِلۡیَاسَ ؕ کُلٌّ مِّنَ الصّٰلِحِیۡنَ.“
বঙ্গানুবাদ:— আমি তাকে দান করেছিলাম ইসহাক আর ইয়াকূব; তাদের প্রত্যেককে সৎ পথ দেখিয়েছিলাম, আর এর পূর্বে নূহকে সৎ পথ দেখিয়েছিলাম আর তার বংশধর থেকে দাঊদ, সুলাইমান, আইঊব, ইউসুফ, মূসা ও হারূনকে (সৎ পথ দেখিয়েছিলাম), সৎ কর্মশীলদের আমি এভাবেই পুরস্কৃত করে থাকি। (কুরআন, সূরা আল-আন’আম; ৬ঃ ৮৪ )
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আরেক স্থানে ইরশাদ করেন,
”اُذۡکُرۡ فِی الۡکِتٰبِ اِبۡرٰهِیۡمَ ۬ؕ اِنَّهٗ کَانَ صِدِّیۡقًا نَّبِیًّا.“
বঙ্গানুবাদ:— এ কিতাবে উল্লেখিত ইবরাহীমের কথা স্মরণ কর, সে ছিল একজন সত্যনিষ্ঠ মানুষ, একজন নবী। (কুরআন, সূরা মারইয়াম; ১৯ঃ ৪১ )
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আবু বকর জাকারিয়া হাফিজাহুল্লাহ তাঁর তাফসীরে বলেন,
“সিদ্দীক” শব্দটি কুরআনের একটি পারিভাষিক শব্দ। এর অর্থ সত্যবাদী বা সত্যনিষ্ঠ। [ফাতহুল কাদীর] শব্দটির সংজ্ঞা সম্পর্কে আলেমদের উক্তি বিভিন্নরূপ। কেউ বলেনঃ যে ব্যক্তি সারা জীবনে কখনও মিথ্যা কথা বলেননি, তিনি সিদ্দীক। কেউ বলেনঃ যে ব্যক্তি বিশ্বাস এবং কথা ও কর্মে সত্যবাদী, অর্থাৎ অন্তরে যেরূপ বিশ্বাস পোষণ করে, মুখে ঠিক তদ্রুপ প্রকাশ করে এবং তার প্রত্যেক কর্ম ও উঠা বসা এই বিশ্বাসেরই প্রতীক হয়, সে সিদ্দীক। [কুরতুবী, সূরা আন-নিসা: ৬৯ নং আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রঃ]
সিদ্দীকের বিভিন্ন স্তর রয়েছে। নবী-রাসূলগণ সবাই সিদ্দীক। কিন্তু সমস্ত সিদ্দীকই নবী ও রাসূল হবেন এমনটি জরুরী নয়, বরং নবী নয়- এমন ব্যক্তি যদি নবী ও রাসূলের অনুসরণ করে সিদ্দীকের স্তর অর্জন করতে পারেন, তবে তিনিও সিদ্দীক বলে অভিহিত হবেন। মারইয়ামকে আল্লাহ্ তা’আলা কুরআনে স্বয়ং সিদ্দীকাহ নামে অভিহিত করেছেন। তিনি নবী নন। কোন নারী নবী হতে পারেন না।
আবু হানিফা রাহিমাহুল্লাহ নবীগণের নিষ্পাপতা বা ইসমাতুল আম্বিয়া সম্বন্ধে তাঁর রচনা আল-ফিকহুল আকবারে বলেন,
”اَلْأَنْبِيَاءُ عَلَيْهِمُ السَّلاَمُ كُلُّهُمْ مُنَزَّهُوْنَ عَنِ الصَّغَائِرِ وَالْكَبَائِرِ وَالْكُفْرِ وَالْقَبَائِحِ، وَقَدْ كَانَتْ مِنْهُمْ زَلاَّتٌ وَخَطِيْئَاتٌ.“
বঙ্গানুবাদ:—নবীগণ সকলেই সগীরা গোনাহ, কবীরা গোনাহ, কুফর ও অশালীন কর্ম থেকে পবিত্র ও বিমুক্ত ছিলেন। তবে কখনো কখনো সামান্য পদস্খলন ও ভুলত্রুটি তাঁদের ঘটেছে। রেফারেন্সঃ আল ফিকহুল আকবার/ ইসমাতুল আম্বিয়া, সাহাবায়ে কেরাম, তাকফীর, সুন্নাত ও ইমামাত
এ বিষয়ে আল্লামা উমর ইবনু মুহাম্মাদ আন-নাসাফী রাহিমাহুল্লাহ বলেন,
”كُلُّهُمْ كَانُوْا مُخْبِرِيْنَ مُبَلِّغِيْنَ عَنِ اللهِ تَعَالَى صَادِقِيْنَ نَاصِحِيْنَ لِلْخَلْقِ.“
বঙ্গানুবাদ:—“তাঁরা সকলেই মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে সংবাদ প্রদান করেছেন এবং প্রচার করেছেন, সত্যবাদী ছিলেন, সৃষ্টির উপদেশদাতা ও কল্যাণকামী ছিলেন। রেফারেন্সঃ তাফতাযানী, শারহুল আকাইদ আন-নাসাফিয়্যাহ, পৃ. ১৩৯
উমর ইবনু মুহাম্মাদ আন-নাসাফী রাহিমাহুল্লাহর এ কথার ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে সা’দ উদ্দীন তাফতাযানী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, এতে ইশারা করা হয়েছে যে, নবীগণ বিশেষভাবে শরীয়তের বিষয়ে, দীনের আহকাম প্রচারের বিষয়ে ও উম্মাতকে নির্দেশনা প্রদানের বিষয়ে মাসূম বা নির্ভুল ও সংরক্ষিত। এক্ষেত্রে তাঁরা ইচ্ছাকৃত কোনো ভুল করেন না সে বিষয়ে সকলেই একমত। অধিকাংশের মতে এক্ষেত্রে তাঁরা অনিচ্ছাকৃত বা বেখেয়ালেও কোনো ভুল করতে পারেন না। অন্যান্য সকল পাপ থেকে তাঁদের মাসূম বা নিষ্পাপ হওয়ার বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। বিস্তারিত আলোচনা নিম্নরূপ: মুসলিম উম্মাহর ইজমা এই যে, নবীগণ ওহী বা নবুওয়াত লাভের পূর্বে ও পরে কুফরী থেকে সংরক্ষিত। অনুরূপভাবে অধিকাংশের মতে তাঁরা ইচ্ছাকৃতভাবে কবীরা গোনাহে লিপ্ত হওয়া থেকেও মাসূম। হাশাবিয়া সম্প্রদায় এ বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেছে।আর ইচ্ছাকৃত সগীরা গোনাহে লিপ্ত হওয়ার বিষয়ে অধিকাংশের মত এই যে, তা সম্ভব। তবে মুতাযিলী নেতা আল-জুবাঈ ও তাঁর অনুসারীরা এ বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেছে। আর নবীগণের জন্য অনিচ্ছাকৃত বা ভুলক্রমে সগীরা গোনাহে লিপ্ত হওয়া সকলের মতেই সম্ভব, তবে যে সকল সগীরা গোনাহ নীচতা প্রমাণ করে তা তাঁদের দ্বারা সম্ভব নয়, যেমন এক লোকমা খাদ্য চুরি করা, একটি দানা ওযনে কম দেওয়া, ইত্যাদি।রেফারেন্সঃ আল্লামা সা’দ উদ্দীন তাফতাযানী রাহিমাহুল্লাহর ব্যাখ্যাকৃত শারহুল আকাইদ আন নাসাফিয়্যাহ, পৃ. ১৩৯-১৪০
মোল্লা আলী কারী রাহিমাহুল্লাহ বলেন,
“ইবনুল হুমাম রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন: ‘আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের অধিকাংশ আলিমের কাছে গ্রহণযোগ্য মত এই যে, নবীগণ কবীরা গোনাহ থেকে সংরক্ষিত, ভুলক্রমে বা অনিচ্ছাকৃতভাবে একক সগীরা গোনাহ করে ফেলা থেকে সংরক্ষিত নন। আহলুস সুন্নাতের কেউ কেউ নবীদের ক্ষেত্রে ভুল করাও অসম্ভব বলে উল্লেখ করেছেন। সঠিকতর বা সহীহ কথা এই যে, কর্মের মধ্যে ভুল হওয়া সম্ভব। সার কথা এই যে, আহলুস সুন্নাতের সকলেই একমত যে, নবীগণ ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো নিষিদ্ধ কর্ম করতে পারেন না।”
রেফারেন্সঃ মোল্লা আলী কারী রাহিমাহুল্লাহর ব্যাখ্যাকৃত শারহুল ফিকহিল আকবার, পৃ. ১০৪-১০৫
ইমাম আল-রাজী তাঁর তাফসীরে কাবীরে লিখেছেন,
“আর আমাদের নিকট সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মত হলো-‘নবুওয়াতি অবস্থা নবীদের থেকে (ইচ্ছাকৃতভাবে) ছোট বড় কোন গুনাহই হওয়া সম্ভব নয়।”
রেফারেন্সঃ ইমাম রাজী রাহিমাহুল্লাহর ‘তাফসীরে কাবীর’ থেকে সূরা বাকারা (২)-এর ৩৬ নং আয়াতের ব্যাখ্যা
এ হচ্ছে নবীগণের নিষ্পাপতা সম্বন্ধে আমাদের আকীদা বা বিশ্বাস। এখন আমরা সে হাদীসটি দেখে নিবো, যার মাধ্যমে তারা আদম আলাইহিস সালামের পাপ করা বিষয়ক দাবিটি করে থাকে।
আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত,
তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ যখন আল্লাহ তা’আলা আদম (আঃ) কে সৃষ্টি করলেন তখন তিনি তার পিঠ মাসেহ করলেন। এতে তাঁর পিঠ থেকে তাঁর সমস্ত সন্তান বের হলো, যাদের তিনি ক্বিয়ামাত পর্যন্ত সৃষ্টি করবেন। তিনি তাদের প্রত্যেকের দুই চোখের মাঝখানে নূরের ঔজ্জল্য সৃষ্টি করলেন, অতঃপর তাদেরকে আদম (আঃ) এর সামনে পেশ করলেন। আদম (আঃ) বললেনঃ হে প্রভু! এরা কারা? আল্লাহ বললেন, এরা তোমার সন্তান। আদমের দৃষ্টি তার সন্তানদের একজনের উপর পড়লো যাঁর দুই চোখের মাঝখানের ঔজ্জল্যে তিনি বিস্মিত হলেন। তিনি বললেন, হে আমার প্রভু! ইনি কে? আল্লাহ তা’আলা বললেনঃ শেষ যামানার উম্মাতের অন্তর্গত তোমার সন্তানদের একজন। তার নাম দাউদ (‘আঃ)। আদম (‘আঃ) বললেনঃ হে আমার রব! আপনি তাঁর বয়স কত নির্ধারণ করেছেন? আল্লাহ বললেনঃ ৬০ বছর। আদম (‘আঃ) বললেনঃ পরোয়ারদিগার! আমার বয়স থেকে ৪০ বছর (কেটে) তাকে দিন। আদম (‘আঃ) এর বয়স শেষ হয়ে গেলে তাঁর নিকট মালাকুত মউত _ আযরাইল) এসে হাযির হন। আদম (‘আঃ) বললেনঃ আমার বয়সের কি আরো ৪০ বছর অবশিষ্ট নেই? তিনি বললেনঃ আপনি কি আপনার সন্তান দাউদকে দান করেননি? রাসুলুল্লাহ (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ আদম (‘আঃ) অস্বীকার করলেন, তাই তার সন্তানরাও অস্বীকার করে থাকে। আদম (‘আঃ) ভুলে গিয়েছিলেন, তাই তাঁর সন্তানদেরও ত্রুটি বিচ্যুতি হয়ে থাকে।
রেফারেন্সঃ জামে’আত-তিরমিজি; হাদিস নং-৩০৭৬
আমরা দেখতে পাচ্ছি এ ঘটনাটি আসলেই হাদীসে রয়েছে। আরো দেখতে পাচ্ছি হাদীসের সনদকে আমাদের মুহাদ্দিসগণ সহীহ বলেছেন। ইমাম আবু ঈসা তিরমিজী, হাকিম, নাসিরউদ্দিন আলবানী রাহিমাহুল্লাহ সকলেই এ হাদীসটির গ্রহণযোগ্যতার বিষয়ে একমত। আর ইসলাম বিদ্বেষীরা মূলত এই হাদীসকে কেন্দ্র করেই ‘নবীরাও পাপ করতেন’ টাইপের একখান গালভরা ফাঁকা বুলি গলা ফাটিয়ে প্রচার করে থাকে। আপাতদৃষ্টিতে যে কারোরই এ হাদীসটি পড়লে এমনটা মনে হতে পারে। যে কারোরই মনে হতে পারে আদম আলাইহিস সালাম তাঁর হায়াত থেকে দাউদ আলাইহিস সালামকে চল্লিশ বছর দেবার পর মৃত্যুকালে পার্থিব মোহে পড়ে সেটা অস্বীকার করেছিলেন। এই হাদিসটি পড়বে যে-কেউই এমনটা ভেবে বসবে।
তবে বিষয়টা মোটেও তেমন নয়। আসলে তারা এখানে বিরাট এক বিভ্রান্তি ছড়িয়ে বিশ্বাসীদের মনে সংশয় বীজ বপন করাটাই নাস্তিক ও অমুসলিমদের উদ্দেশ্য । প্রবাদে যাকে বলে, ‘শুভংকরের ফাঁকি’।
প্রথমে আমরা হাদীসটিতে থাকা আদম (আঃ) -এর অস্বীকার সংক্রান্ত অংশটি নিরীক্ষণ করবো, যার মাধ্যমে ইসলামবিদ্বেষীরা তাঁকে (আলাইহিস সালাম) ‘মিথ্যাবাদী’ ট্যাগ দিতে চায়। জামি আত-তিরমিজীর হাদীসটিতে আমরা পাই, আদম (‘আঃ) এর বয়স শেষ হয়ে গেলে তাঁর নিকট মালাকুত মউত (আযরাইল) এসে হাযির হন। আদম (আঃ) বললেনঃ আমার বয়সের কি আরো ৪০ বছর অবশিষ্ট নেই? তিনি বললেনঃ আপনি কি আপনার সন্তান দাউদকে দান করেননি? রাসুলুল্লাহ (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ আদম (‘আঃ) অস্বীকার করলেন, তাই তার সন্তানরাও অস্বীকার করে থাকে। আদম (‘আঃ) ভুলে গিয়েছিলেন, তাই তাঁর সন্তানদেরও ত্রুটি বিচ্যুতি হয়ে থাকে।
কোন একটা বিষয়কে অস্বীকার করাকে দু’ভাবে বিচার করা যায়।
১/ হয়তো অস্বীকারকারী বিষয়টা জানে— তবুও অস্বীকার করছে;
২/ নয়তো অস্বীকারকারী বিষয়টা জানে না— তাই অস্বীকার করছে।
একটা উদাহরনের মধ্য দিয়ে বিষয়টাকে বুঝে নেয়া যাক।
ধরুন, আপনার বন্ধু রাসেল। তার কাছ থেকে আপনি কিছু টাকা ধার নিলেন। কোন এক কারণে বহুদিন হয়ে যায় তার পাওনা পরিশোধ করা হয়না। একদিন সে এসে আপনাকে টাকার কথা মনে করিয়ে দিলে আপনি টাকা ধারের বিষয়টা—
মনে থাকার পরও তা অস্বীকার করলেন। কিংবা ভুলে যাবার কারণে অস্বীকার করলেন।
দুটো বিষয় কি এক হলো?
‘ইচ্ছাকৃত অস্বীকার’ আর ‘ভুলে যাওয়ায় অস্বীকার’ কি এক?
আদম আলাইহিস সালামের বেলায়ও ঠিক এমনটাই ঘটেছিল। হাদিসে স্পষ্টত বলা আছে, রাসুলুল্লাহ (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ আদম (‘আঃ) অস্বীকার করলেন, তাই তার সন্তানরাও অস্বীকার করে থাকে। আদম (আঃ) ভুলে গিয়েছিলেন, তাই তাঁর সন্তানদেরও ত্রুটি বিচ্যুতি হয়ে থাকে।
আমরা জানি, আদম আলাইহিস সালাম ছিলেন বিস্মৃতিপ্রবণ নবী। জীবনের সবচেয়ে হতাশাজনক ‘নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল খাওয়ার ঘটনা’ সেটাই নিশ্চিত করে। এছাড়া হাদীসেও তার প্রমাণ পাওয়া যায়। কিয়ামতের দিনেও তাঁর আফসোসের কারণ হবে বিস্মৃতিপ্রবণতার কারণে হয়ে যাওয়া তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল।
আবু হুরাইরাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
“আমি হব কিয়ামাতের দিন মানবকুলের নেতা। তোমাদের কি জানা আছে তা কেন? কিয়ামতের দিন পূর্বাপরের সকল মানুষ এমন এক প্রান্তরে একত্রিত হবে, যেখানে একজন আহ্বানকারীর আহ্বান সকলে শুনতে পাবে এবং সকলেই এক সাথে দেখবে। সূর্য নিকটে এসে যাবে। মানুষ এমনি কষ্ট-ক্লেশের সম্মুখীন হবে, যা হয়ে পড়বে অসহনীয় ও অসহ্যকর। তখন লোকেরা বলবে, তোমরা যে বিপদের সম্মুখীন হয়েছ, তা কি দেখতে পাচ্ছ না? তোমরা কি এমন কাউকে খুঁজে বের করবে না, যিনি তোমাদের রবের কাছে তোমাদের জন্য সুপারিশকারী হবেন? কেউ কেউ অন্যদের বলবে যে, আদম (আলাইহিস সালাম)-এঁর কাছে চলো। তখন সকলে তাঁকে এসে বলবে, আপনি মানবজাতির পিতা। আল্লাহ তাআলা আপনাকে নিজ হাতে সৃষ্টি করেছেন এবং তাঁর রূহ আপনার মধ্যে ফুঁকে দিয়েছেন এবং ফেরেশতাদের হুকুম দিলে তাঁরা আপনাকে সিজদাহ করেন। আপনি আপনার রবের নিকট আমাদের জন্য সুপারিশ করুন। আপনি কি দেখছেন না, আমরা কীসের মধ্যে আছি? আপনি কি দেখছেন না, আমরা কোন অবস্থায় পৌঁছেছি? তখন আদম (আলাইহিস সালাম) বলবেন, আজ আমার রব এত রাগান্বিত হয়েছেন যে আগেও কোনোদিন এরূপ রাগান্বিত হননি আর পরেও এরূপ রাগান্বিত হবেন না। তিনি আমাকে একটি গাছের নিকট যেতে নিষেধ করেছিলেন, কিন্তু আমি অমান্য করেছি, নফস আমার, নফস আমার, নফস আমার, তোমরা অন্যের কাছে যাও,তারপর তারা মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর কাছে এসে বলবে, হে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)! আপনি আল্লাহর রাসূল এবং শেষ নবী। আল্লাহ তাআলা আপনার পূর্বাপর সকল পাপ ক্ষমা করেছেন। আপনি আমাদের জন্য আপনার রবের কাছে সুপারিশ করুন। আপনি কি দেখছেন না আমরা কীসের মধ্যে আছি? তখন আমি আরশের নিচে এসে আমার রবের সামনে সিজদাহ দিয়ে দিব। তারপর আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রশংসা ও গুণগানের এমন সুন্দর নিয়ম আমার সামনে খুলে দিবেন, যা এর পূর্বে অন্য কারও জন্য খোলেননি। এরপর বলা হবে, হে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)! তোমার মাথা ওঠাও। তুমি যা চাও, তোমাকে দেয়া হবে। তুমি সুপারিশ কর, তোমার সুপারিশ কবুল করা হবে।” রেফারেন্সঃ
এখান থেকে আমরা দেখতে পারলাম, আদম (আলাইহিস সালাম)-এঁর নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল খাবার মাধ্যমে হওয়া ভুলটি তাঁর (আলাইহিস সালাম)-এঁর জীবনের সবচেয়ে বড়ো ট্রাডেজি। আর সেই ভুলটি হয়েছিল তাঁর ‘ভুলে যাওয়া বা বিস্মৃতিপ্রবণতা’-র কারণে। অর্থাৎ তার জীবনের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা ছিল, ‘ভুলে যাওয়া’। আর আমরা যে আদম (আলাইহিস সালাম)-এঁর অস্বীকার সংক্রান্ত ঘটনাকে তাঁর বিস্মৃতির কারণ বলে দাবি করছি, এটা নিছক দাবি বা ধারণাই নয়; উপরন্তু হাদীসেও তার প্রমাণ মেলে। উল্লেখিত হাদীসটিতে আমরা এটাও পাই, তিনি তাঁর জীবন থেকে তাঁর পরবর্তী সন্তান দাউদ আলাইহিস সালামকে চল্লিশ বছর দিয়ে দেয়ার বিষয়টা ‘ভুলে যাওয়া’র কারণে অস্বীকার করেছিলেন।
হাদীসের এ অংশটি লক্ষ্য করুন, “রাসুলুল্লাহ (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ আদম (‘আঃ) অস্বীকার করলেন, তাই তার সন্তানরাও অস্বীকার করে থাকে। আদম (‘আঃ) ভুলে গিয়েছিলেন, তাই তাঁর সন্তানদেরও ত্রুটি বিচ্যুতি হয়ে থাকে।”
‘ভুলে যাওয়া’ আর ‘ভুল করা’ শব্দগুলো কি ‘ভুলে যাওয়ায় অস্বীকার’-এর প্রতিনিধিত্ব করেনা?
এবারে হয়তো অভিযোগকারী তার ‘তুরুপের তাস’-তুল্য শেষ অভিযোগটি করে বসতে পারে। বলতে পারে, “আপনার কথানুযায়ী যদি আদম তার হায়াত দিয়ে দেয়ার বিষয়টা ভুলে যাওয়ায় ফলেই অস্বীকার করে থাকেন, তাহলে তিনি মৃত্যুর সময় কীভাবে বুঝতে পারলেন তার হায়াত এখনো বাকি আছে?”
অর্থাৎ তাদের প্রশ্ন হবে, আদম (আলাইহিস সালাম) যদি তার জীবন থেকে চল্লিশ বছর দাউদ আলাইহিস সালামকে দেবার ঘটনাটা ভুলে যাবার দরুন মৃত্যুকালে তা অস্বীকার করে বসেন, তাহলে তিনি কী করে বুঝতে পারলেন তাঁর হায়াতের চল্লিশ বছর এখনো বাকি আছে? তিনি তো তার হায়াত জানতেন না যে, হিসেব কষে বলতে পারবেন তার হায়াতের কোনো অংশ এখনো বাকি আছে কিনা। এটা কি প্রমাণ করেনা, তার চল্লিশ বছর দেবার ঘটনাটা মনে ছিল— তবু তিনি তা না জানার ভান করে হায়াত থেকে দিয়ে দেয়া চল্লিশ বছরের দাবি করে বসেছিলেন?
এর জবাবটা আরো সহজ, আলহামদুলিল্লাহ! স্বাভাবিকভাবে যদি এ সংক্রান্ত প্রায়সব হাদীস কারোর জানা না থাকলেই এমন একটা অভিযোগ করে বসতে পারে। আদম (আলাইহিস সালাম)-এঁর অস্বীকার সংক্রান্ত ঘটনাটি হাদীসে কুদসীতেও বর্ণিত আছে। সেখানে আমরা দেখতে পাই, তিনি তাঁর (আলাইহিস সালাম) হায়াতের সময়কাল সম্পর্কে আল্লাহর কাছ থেকে অন্য কোনো এক সময়ে জেনেছিলেন।
হাদীসটি বর্ণনা করেছেন আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহ যখন আদমকে সৃষ্টি করেন ও তাঁর মধ্যে রূহ সঞ্চার করেন। আল্লাহর যতদিন ইচ্ছা ছিল তিনি জান্নাতে অবস্থান করেন, অতপর সেখান থেকে অবতরণ করানো হয়, এরপর থেকে তিনি নিজের বয়স হিসেব করতেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘তাঁর (আলাইহিস সালাম) নিকট মালাকুল মউত (আলাইহিস সালাম) আসল, অতপর তিনি অস্বীকার করেছে বলে তাঁর (আলাইহিস সালাম) সন্তানেরাও অস্বীকার করে, তিনি ভুলে গেছেন তাই তাঁর (আলাইহিস সালাম) সন্তানরাও ভুলে যায়।’ তিনি বলেন, ‘সে দিন থেকে লিখা ও সাক্ষী রাখার নির্দেশ দেয়া হয়’।”
রেফারেন্সঃ হাদিসে কুদসী/১২৪
হাদীসটি ইবনু হিব্বান, হাকিম, আবু আসিম রাহিমাহুমুল্লাহ তাঁদের নিজ নিজ হাদীস সংকলনগ্রন্থে স্থান দিয়েছেন। আবু আবদুল্লাহ মুস্তাফা আল আজাদী রাহিমাহুল্লাহ তাঁর হাদীসে কুদসীর সংকলনগ্রন্থ ‘সহীহ হাদীসে কুদসী’-তে তা নিয়ে এসেছেন। হাদীসের এ অংশটি আবার লক্ষ্য করুন, “আল্লাহর যতদিন ইচ্ছা ছিল তিনি জান্নাতে অবস্থান করেন, অতঃপর সেখান থেকে অবতরণ করানো হয়, এরপর থেকে তিনি নিজের বয়স হিসেব করতেন।” রেফারেন্সঃ হাদিসে কুদসী; পৃষ্টা নংঃ ১৪৮
আমরা দেখতে পাচ্ছি আদম আলাইহিস সালাম আল্লাহর কাছ থেকে তাঁর হায়াত সম্পর্কে জেনেছিলেন। তিনি তাঁর (আলাইহিস সালাম) হায়াত আল্লাহর কাছ থেকে জেনেছিলেন কেবল এটুকুই নয়, বরং হায়াত শেষ হতে আর কতদিন বাকি আছে তা গণনাও করতেন। যদ্দরূন মালাকুল মাউত আলাইহিস সালাম প্রাণহরণ করতে এলে তিনি হিসেব করে বলতে পেরেছিলেন, “দ্রুত চলে এসেছ, আমার জন্য এক হাজার বছর লিখা হয়েছে।” আর দুর্ভাগ্যবশত তিনি চল্লিশ বছর দান করার ঘটনাটা ভুলে যাওয়ায় মালাকুল মাউত আলাইহি সালামের তা মনে করাবার চেষ্টা করলেও তিনি তা অস্বীকার করেন। তাছাড়া আমরা আগেই জেনেছি, তাঁর (আলাইহি সালাম)-এর। ‘অস্বীকার’ করাটা ছিল ‘ভুলে যাওয়া’-র ফল।
আলোচনা আপাতত এখানেই ক্ষ্যান্ত হচ্ছে। যারা সত্যান্বেষী, সত্যে বিশ্বাসী, তাদের জন্য এতেই রয়েছে সত্যের চাবিকাঠি। যারা সত্যকে খুঁজে বেড়ায়, সত্যকে বুকে আঁকড়ে ধরতে চায়, তাদের চোখে এটা ‘পাপ/অপরাধ’ বলে ধরা দিতে পারে না। তারা জানে, তারা বুঝে, ‘ভুলে যাওয়া’ আর ‘মোহে পড়ে অস্বীকার করা’ দুটো এক নয়। দুটো এক হতে পারে না। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর।
মহান আল্লাহু আয্যা ওয়া জাল্লা বলেন,
”اِنَّ مَثَلَ عِیۡسٰی عِنۡدَ اللّٰهِ کَمَثَلِ اٰدَمَ.“ নিশ্চয় আল্লাহর নিকট ঈসার দৃষ্টান্ত আদমের মত।
রেফারেন্সঃ কুরআন/৩/৫৯
ইসলাম সম্পর্কিত অভিযোগের জবাব – Faith and Theology (faith-and-theology.com)
এই বিষয়ে শায়েখ শায়খ আহমাদুল্লাহ;র বক্তব্য।