আল্লাহর অস্তিত্ব প্রমাণের বোঝা কার উপর? 

আল্লাহর অস্তিত্ব প্রমাণের বোঝা কার উপর? 

দুই পক্ষ যখন কোন বিষয়ে আলোচনায় থাকে এবং এক পক্ষ কোন দাবি করলে তার দাবির ন্যায্যতা বা দাবির সত্যতা প্রমাণ করার দায়িত্ব যে দাবি করবে তার উপর। প্রমাণের বোঝা ব্যবহার করা হয় একটি যৌক্তিক ভ্রান্তির ক্ষেত্রে, যা অজ্ঞতা থেকে যুক্তি হিসাবে পরিচিত (Argument from ignorance)। এই যৌক্তিক ভ্রান্তি তখনই ঘটে যখন একটি প্রস্তাবকে সত্য বলে মেনে নেওয়া হয় কারণ এটি এখনও মিথ্যা প্রমাণিত হয়নি বা একটি প্রস্তাবকে মিথ্যা বলে মেনে নেওয়া হয় কারণ এটি এখনও সত্য বলে প্রমাণিত হয়নি। স্রষ্টার অস্তিত্বের ক্ষেত্রে আস্তিক নাস্তিক উভয় পক্ষই এই ভ্রান্ত যুক্তির আশ্রয় নিয়ে থাকে অনেক সময়। যদিও নাস্তিকতার ভিত্তিটাই এই ভ্রান্ত যুক্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে। অন্যদিকে, আস্তিকরা সব সময় এই ভ্রান্ত যুক্তির আশ্রয় নেয় এমন না। একজন আস্তিক যখন এই ভ্রান্ত যুক্তির আশ্রয় নিয়ে থাকে তখন ব্যাপারটি এমন হয় যে, নাস্তিকরা এটা প্রমাণ করতে পারেনি যে স্রষ্টার অস্তিত্ব নেই, তাই স্রষ্টা অবশ্যই অস্তিত্বশীল। অন্যদিকে, নাস্তিক্যবাদ অনুযায়ী, যেহেতু আস্তিকরা স্রষ্টার অস্তিত্বের প্রমাণ দিতে পারেনি, সেহেতু স্রষ্টার অস্তিত্ব থাকা সম্ভব না।

যাইহোক, দুপক্ষের আলোচনাতে যেহেতু যিনি দাবি করবেন বার্ডেন অব প্রুফ বা প্রমাণের বোঝা দাবিকারীর উপর তাই নাস্তিকদের দাবি হলো, স্রষ্টা আছে এই দাবি আস্তিকরা করে তাই এর প্রমাণও তাদের দিতে হবে। আপত দৃষ্টিতে নাস্তিকদের এই দাবিটি যৌক্তিক। মনে করুন, কোন একজন বিজ্ঞানী যদি এসে বলে আমি এমন একটি জিনিস আবিষ্কার করেছি যেটা দিয়ে মানুষ চাইলে আকাশে উড়তে পারবে। তখন আপনি বিজ্ঞানীকে বললেন ঠিক আছে আপনি দেখান যে কি এমন জিনিস আবিষ্কার করলেন যেটা দিয়ে মানুষ আকাশে উড়তে পারবে? তো বিজ্ঞানী আপনাকে বললো, আপনি প্রমাণ করে দেখান যে আমি এমন জিনিস বানাই নি যেটা দিয়ে আকাশে উড়া যায়! বিজ্ঞানীর এই যুক্তি কি আপনি মেনে নিবেন? অবশ্যই নিবেন না! কারণ দাবি তার প্রমাণার বোঝাও তার। সুতরাং, কেউ যদি বলে স্রষ্টা আছে সেহেতু এই দাবির পক্ষে প্রমাণ উপস্থাপন করার বোঝাও তার উপর। যদি কেউ তা না করে বলে যে, তুমি প্রমাণ করে দেখাও যে স্রষ্টা নেই। যদি তুমি প্রমাণ করতে না পারো যে, স্রষ্টা বলতে আদতে কিছু নেই তাহলে স্রষ্টার অস্তিত্ব মেনে নিতে হবে। ব্যাপারটি এমন হলে তা অজ্ঞতামূলক ভ্রান্তি বলে বিবেচিত হবে। সুতরাং, দাবি যার প্রমাণের বোঝাও তার এই যুক্তির উপর ভিত্তি করে যে কেউই আমাদের কাছে স্রষ্টার অস্তিত্বের পক্ষে যুক্তি-প্রমাণ চাওয়াটা অযৌক্তিক কিছু নয়। কিন্তু ‘দাবি যার প্রমাণ করার বোঝাও তার’ এই যুক্তিটিকে রিভার্স করে আমরা প্রমাণের বোঝা নাস্তিকদের দিকেও ঘুরিয়ে দিতে পারি। তবে এর মানে এই না যে আমরা স্রষ্টার অস্তিত্বের প্রমাণ দিতে পারি না। ইতোমধ্যেই আমরা স্রষ্টার অস্তিত্বের পক্ষে একাধিক প্রমাণ উপস্থাপন করেছি।

বার্ট্রান্ড রাসেলের চায়না চা-পাত্রের যুক্তি

‘দাবি যার প্রমাণ তার’ এই বিষয়টি বুঝার জন্য আমাদের দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলের Teapot Argument সম্পর্কে জানতে হবে। নাস্তিকরা প্রায়শই বার্ট্রান্ড রাসেলের টিপট যুক্তি ব্যবহার করে ঈশ্বরের অস্তিত্বের অবিশ্বাসের পক্ষে। দার্শনিক রাসেল মূলত যুক্তিটিকে এভাবে উপস্থাপন করেছেন;

যদি আমি প্রস্তাব করি যে পৃথিবী এবং মঙ্গল গ্রহের মধ্যে, একটি উপবৃত্তাকার কক্ষপথে সূর্যের চারপাশে ঘূর্ণায়মান একটি চায়না চা-পাত্র রয়েছে এবং চা-পাত্রটি এতোটাই ছোট যে আমাদের সবচেয়ে শক্তিশালী টেলিস্কোপ দিয়েও দেখা যাবে না। তাই কেউই এই দাবিকে অস্বীকার করতে সক্ষম হবে না। এই কারণে দার্শনিক রাসেল বলেন, যেহেতু তার এই বক্তব্যকে অপ্রমাণিত করা যায় না, তাই এটাকে সন্দেহ করাটা একটি অসহনীয় অনুমান, আমি সঠিক কথা (উপবৃত্তাকার কক্ষপথে সূর্যের চারপাশে ঘূর্ণায়মান একটি চায়না চা-পাত্র রয়েছে) বলেছি এটাই মনে করা উচিত।

এই যুক্তিটি আপাতদৃষ্টিতে একটি যুক্তিসংগত উপসংহারের দিকে নির্দেশ করে যে, ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ না থাকলে কাউকে ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিশ্বাস করতে বাধ্য করা উচিত নয়। যাইহোক, কিছু নাস্তিক টিপট আর্গুমেন্টকে ভিন্নভাবে ব্যবহার করে। তারা এই যুক্তির মাধ্যমে দেখানোর চেষ্টা করে যে, যদি ঈশ্বরের পক্ষে প্রমাণের অভাব থাকে তবে কাউকে বিশ্বাস করা উচিত যে ঈশ্বর নেই। অর্থাৎ, যেহেতু কেউ স্রষ্টার প্রমাণ দিতে পারেনি তাই স্রষ্টা নেই এমনটা বিশ্বাস করা উচিত। কিন্তু এটি অজ্ঞতা ভ্রান্ত যুক্তির শামিল তা উপরে আলোচনা করে এসেছি।

রাসেলের টিপট আর্গুমেন্ট থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, কোন কিছু বিশ্বাস করতে হলে বিশ্বাসের স্বপক্ষে অবশ্যই প্রমাণ লাগবে। কিন্তু ‘কোন কিছু বিশ্বাস করতে হলে তার পক্ষে প্রমাণ লাগবে’ এই দাবির পক্ষে কি নাস্তিকরা কোন প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারবে? প্রমাণ উপস্থাপন করতে না পারলে কি আমরা এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারি যে, কোন কিছু বিশ্বাস করতে হলে বিশ্বাসের স্বপক্ষে কোন প্রমাণের প্রয়োজন নেই? যুক্তিপ্রবণ মানুষ হিসেবে আমরা নিশ্চয়ই এমন কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারিনা। আমরা কোন কিছু বিশ্বাসের পক্ষে প্রমাণ চাই কারণ প্রমাণ চাওয়াটা আমাদের কাছে বোধগম্য মনে হয়। একইভাবে স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাস করাটাই আমাদের কাছে বোধগম্য মনে হয়। আমাদের চারপাশের প্রকৃতি আমাদের এটাই জানান দেয় যে এই মহাবিশ্বের একজন স্রষ্টা থাকা প্রয়োজন। কারণ আমরা কার্যকারণ সম্পর্কে জানি। কেউ কার্যকারণ সম্পর্ককে অস্বীকার করতে পারবে না! আবার স্রষ্টার বিশ্বাস মানব মনের স্বাভাবিক এবং সহজাত বিশ্বাস। যাইহোক, রাসেলের টিপট আর্গুমেন্টটি স্রষ্টার অস্তিত্ব অস্বীকার করতে ব্যর্থ। এটি আমাদের বুঝায় যে, কোন কিছুর স্বপক্ষে প্রমাণ থাকলে বিশ্বাস করা উচিত এবং প্রমাণ না থাকলে বিশ্বাস করা উচিত না। তবে প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে কোন কিছুকে অস্বীকার করা হলে তা অজ্ঞতা ভ্রান্তি বলে বিবেচিত হবে।

রাসেলের যুক্তিটিতে একটি চায়না চা-পাত্র সম্পর্কে বলা হয়েছে যেটি পৃথিবী এবং মঙ্গল গ্রহের মধ্যে, একটি উপবৃত্তাকার কক্ষপথে সূর্যের চারপাশে ঘূর্ণায়মান। কিন্তু একটি চা-পাত্র স্বাভাবিকভাবে এমন একটি বস্তু যা মহাকাশে থাকার কথা নয়। সুতরাং, রাসেলের টিপট আর্গুমেন্টন্টের চিন্তাটি মহাকাশে ঘটতে পারে না যদিনা কোন মানুষ ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে চা-পাত্রটিকে সেখানে না রেখে আসে। অথবা, কোন প্রাকৃতিক কারণ পৃথিবী থেকে চা-পাত্রটিকে সেখেনে ফেলে না আসে। যাইহোক, এই অর্ধায়ে আমরা রাসেলের যুক্তিটির অসারতা নিয়ে কথা বলতে চাই না। আমরা এই Teapot Argument কে রিভার্স করে প্রমাণের বোঝা নাস্তিকদের দিকে ঘুরিয়ে দিতে পারি এবং আমরা তাই করবো। এক্ষেত্রে আমরা একটি কাল্পনিক গল্পের সহযোগিতা নিতে পারি।

মনে করুন, মিসবাহ এবং উদয় কোন এক কফিশপে বসে আড্ডা দিচ্ছে। তাদের আড্ডার টপিক হলো স্রষ্টার অস্তিত্বের প্রমাণের বোঝা কার উপর?

উদয়, মিসবাহকে উদ্দেশ্য করে রাসেলের টিপট আর্গুমেন্টটি শুনিয়ে বলেন, “যেহেতু তুই দাবি করেছিস স্রষ্টা বলতে কেউ আছে তাই তোকেই প্রমাণ করতে হবে যে স্রষ্টা আছে”।

মিসবাহ রাসেলের চা-পাত্র আর্গুমেন্টটিকে রিভার্স করলেন। সে তার বন্ধু উদয়কে বললো, “ওই যে কফিশপের বাহিরে মাঠের শেষ প্রান্তে একটা বড় বাড়ি দেখতে পাচ্ছিস”?

উদয়- “হুম দেখতে পাচ্ছি। বাড়িটি খুব সুন্দর করে ডিজাইন করা, এমন বাড়ি এই শহরে খুব একটা দেখা যায় না”।

মিসবাহঃ “আচ্ছা, এই জায়গায় বাড়িটি কীভাবে তৈরি হলো?”

উদয়ঃ “অবশ্যই কোন বাড়ি প্রস্তুতকারী মিস্ত্রি, ইঞ্জিনিয়ারসহ বাড়িটি তৈরি করেছেন”।

মিসবাহঃ “কিন্তু এখানে কোন মিস্ত্রি বা ইঞ্জিনিয়ার কখনোই আসেনি। কোন বুদ্ধিমান সচেতন সত্তা এই বাড়িটি তৈরি করেনি। বাড়িটি শূন্য থেকে নিছক দুর্ঘটনাক্রমে তৈরি হয়েছে”।

উদয়ঃ “তুই যে দাবিটি করেছিস তা একজন যৌক্তিক মানুষ হিসেবে আমাদের কাছে নিশ্চয়ই বোধগম্য নয়। একজন বুদ্ধিমান মানুষ হিসেবে আমি কখনোই এই দাবি মেনে নিতে পারি না”।

মিসবাহঃ “কিন্তু কেন এই দাবিটি বোধগম্য নয়? দাবিটিকে বোধগম্য বলার পূর্বে তোর উচিত আমাকে প্রমাণ দেওয়া যে এই বাড়িটি শূন্য থেকে অস্তিত্বে আসেনি”।

উদয়ঃ “হা হা হা… তুই তো বার্ডেন অব প্রুফ ফ্যালাসি করছিস! যেহেতু বাড়িটি শূন্য থেকে অস্তিত্বে এসেছে এই দাবি তুই করেছিস তাই তোকেই প্রমাণ করতে হবে যে এই বাড়িটি শূন্য থেকেই এসেছে। আমি কেন প্রমাণ করবো এই বাড়িটি শূন্য থেকে আসেনি”!

মিসবাহঃ “আচ্ছা, তুই তোর অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান এর মাধ্যমে বুঝতে পারলি যে এই বাড়িটি শূন্য থেকে অস্তিত্ব আসতে পারে না। এই দাবিটি একদমই বোধগম্য নয়। কারণ তুই জানিস Cause & Effect সম্পর্কে। কার্য-কারণ সমন্ধ ছাড়া কোন কিছুই নিছক দুর্ঘটনাক্রমে শূন্য থেকে সুনিপুণভাবে সৃষ্টি হতে পারে না। আমাদের কাছে এটাই বোধগম্য। তাই আমি যখন বললাম ঐ বাড়িটি শূন্য থেকে সৃষ্টি হয়েছে তখনই তুই বললি এটা বোধগম্য নয়, আমার উচিত প্রমাণ করা যে কীভাবে বাড়িটি শূন্য থেকে অস্তিত্বে এসেছে! আমরা জানি কার্যকারণ সমন্ধ ছাড়া কোন কিছুই শূন্য থেকে সুনিপুণভাবে অস্তিত্বে আসতে পারে না। তাহলে একজন নাস্তিক যখন দাবি করে বাড়িটির মতো মহাবিশ্ব শূন্য থেকে সৃষ্টি হয়েছে তখন সেই দাবিটিও নিশ্চয়ই বোধগম্য নয়! এবং এখানেও বার্ডের অফ প্রুফ অর্থাৎ, মহাবিশ্ব যে শূণ্য থেকে সৃষ্টি হয়েছে তা প্রমাণ করার বোঝা নাস্তিকদের উপর! নাস্তিককে প্রমাণ করতে হবে যে, কীভাবে এই মহাবিশ্ব শূন্য থেকে সৃষ্টি হয়েছে”।

কাল্পনিক এই গল্পটির মাধ্যমে আমরা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছি যে, শুধু স্রষ্টার অস্তিত্ব স্বীকার করে নিলেই যে প্রমাণের বোঝা আস্তিকের উপর আসে তা নয়! বরং, যারা স্রষ্টার অস্তিত্ব অস্বীকার করে তাদের উপরও প্রমাণ বোঝা আছে।

কোনো প্রস্তাবের জন্য প্রমাণ বা ন্যায্যতার প্রয়োজন কেন?

ইতিমধ্যে স্রষ্টার অস্তিত্বের প্রমাণ আমরা দিয়েছি এবং স্রষ্টা আছে কি নেই সেই বিষয়ে আস্তিকদের প্রমাণ দেওয়ার জরুরি না তাও রাসেলের চায়না-চা-পাত্র যুক্তির মাধ্যমে প্রমাণ করেছি। স্রষ্টার অস্তিত্বের পক্ষে আস্তিকরা কোনো যুক্তি উপস্থাপন করতে না পারলেও এটা প্রমাণিত হয় না যে স্রষ্টা বলতে কিছু নেই। সাধারণত এটা বিশ্বাস করে নেওয়া হয় যে, কেউ যখন কোন কোন দাবি করবে তখন সেই দাবির পক্ষে যুক্তি-প্রমাণ- ন্যায্যতা তাকেই দিতে হবে। তাই আল্লাহর অস্তিত্ব প্রমাণ করার দায়িত্ব তাদের উপর যারা কিনা স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাস করে বা স্রষ্টার অস্তিত্বের দাবি করে। কিন্তু দাবিকারীর উপর এই প্রমাণের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয় কেন? সম্ভবত এর কারণ হতে পারে যে, দাবিকারীর দাবিকে তখনই জ্ঞান বলা যায় যখন দাবির পক্ষে শক্তিশালী কোনো যুক্তি বা ন্যয্যতা উপস্থাপন করা হবে। সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব বিষয়ক আলোচনাতে বিষয়টি এমন হবে; যেহেতু সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বের পক্ষে আস্তিকরা দাবী করে তাই আস্তিকরা যতক্ষণ সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বের পক্ষে কোন ন্যায়সংগত, সত্য যুক্তি উপস্থাপন করবে না ততক্ষণ তা জ্ঞান বলে বিবেচিত হবে না। তাই বার্ডেন অফ প্রুফ (প্রমাণের বোঝা) আস্তিকদের কাঁধেই। বিষয়টা অনেকটা এমন যে,

১. সৃষ্টিকর্তার বিশ্বাস ন্যায্য বা নিশ্চিত হতে পারে কেবল মাত্র ভালো যুক্তির মাধ্যমে।

২. যদি সৃষ্টিকর্তার বিশ্বাসের পক্ষে কোনো ভালো যুক্তি না থাকে।

৩. তাহলে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব ন্যায্য বা নিশ্চিত নয়।

এই বিতর্কের শুরুতে আমি আস্তিক-নাস্তিকের উভয়ের কাছে যে প্রশ্নটি করতে চাই, এমন কোনো জ্ঞান কি নেই যা আমরা কোনো প্রকার যুক্তি প্রমাণ ছাড়াই বিশ্বাস করি? আমাদের সমস্ত বিশ্বাস কি যুক্তির মধ্যেই বহাল থাকে?

আমরা বিশ্বাস করি, অন্যান্য মানুষ তারা আমাদের মতো সচেতন এবং তারা নিছক মেশিনের মতো কোনো কৃত্রিম রোবট নয়। বাহ্যিক জগতের বিশ্বাসের কথাও বিবেচনা করুন। আমরা কখনো এমনটা মনে করিনা যে আমাদের এই জগতের বাস্তব কোনো অস্তিত্ব নেই, আমরা আসলে একটা ম্যাট্রিক্স সিমুলেশন বা নিছক স্বপ্নের মধ্যে রয়েছি। দূরের কোনো অজানা গ্রহের একটি পাত্রের মধ্যে ভেসে বেড়ানো নিছক এক মস্তিষ্ক হলাম আমরা। আর তাতে কলকাঠি নাড়িয়ে আমাদের হৃদিয়ে অনুভূতির সৃষ্টি করছে কোনো এলিয়েন। বরং আমরা বিশ্বাস করি বা আমাদের বেশিরভাগের কাছেই এটা স্পষ্ট যে ‘বাহ্যিক জগৎ’ কোনো ম্যাট্রিক্স সিমুলেশন বা নিছক স্বপ্ন নয়। এর বাস্তব অস্তিত্ব রয়েছে। এছাড়াও আমরা বিশ্বাস করি আমাদের যৌক্তিক চিন্তার প্রক্রিয়াগুলি মহাবিশ্ব সম্পর্কে সত্যিকারের বিশ্বাসে পৌঁছানো বা সত্য জ্ঞান অর্জনের জন্য সক্ষম। আমাদের যৌক্তিক অনুষদগুলো অ-ভ্রান্ত। যদি আমরা এমনটা বিশ্বাস না করি তাহলে মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমরা সন্দেহ প্রকাশ করতে পারি না। কারণ, আমাদের যৌক্তিক অনুষদগুলো যদি ভ্রান্ত হয় তাহলে আমরা কীভাবে বুঝবো যে এই ধরনের সন্দেহ প্রকাশের জন্য সঠিক উপায় কি? তখন আমাদের সকল জ্ঞানকে ভ্রান্ত বলে বিবেচিত করতে হবে। আমাদের অতীত সম্পর্কে কি বলবেন? উদাহরণস্বরূপ, আপনার খুব কাছের বন্ধু আপনাকে বললো, আমাদের অতীত, গতকাল আমরা কি করেছি, গত বছর আমরা কি করেছি, স্কুল জীবনে আমরা যা যা করেছি এগুলো আসলে বাস্তবে ঘটেনি। এগুলো ছিল আমাদের মস্তিষ্কের বিভ্রম। এমন উদ্ভট উপস্থাপনার পরে সে আপনাকে প্রশ্ন করলো, তুই কী অতীতের অস্তিত্বে বিশ্বাস করিস? আপনি কি কোনোভাবে প্রমাণ করতে পারবেন যে, না আমাদের অতীত অসলেই বাস্তব! এটা মস্তিষ্কের কোনো বিভ্রম নয়! হয়ত আমরা কখনোই প্রমাণ করতে পারবো না। তবে আমরা বিশ্বাস করি যে অতীতে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো বাস্তব। এছাড়া গাণিতিক সত্যতা অর্থাৎ ২+৩=৫ এটার পক্ষেও কোনো যুক্তি নেই।

‘সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব সম্পর্কে যে দাবি আস্তিকরা করে থাকে তা ততক্ষণ পর্যন্ত জ্ঞান হতে পারে না যতক্ষণ পর্যন্ত এই দাবির পক্ষে শক্তিশালী কোনো যুক্তি উপস্থাপন করা হবে’ এই আলোচনাতে ফিরে আসি। উপরে উল্লিখিত বিশ্বাসের যে ধরণ সম্পর্কে বলেছি যেমন, বাহ্যিক জগতের অস্তিত্ব, আমাদের অস্তিত্ব, অতীতের অস্তিত্ব, আমাদের যৌক্তিক অনুষদের অ-ভ্রান্ততা, গাণিতিক সমীকরণ, এ সমস্ত বিশ্বাস যেগুলোকে আমরা যৌক্তিক মনে করি কিন্তু এগুলোর পক্ষে কোনো যুক্তি আছে কি? আমরা চাইলেও কি এগুলোর পক্ষে ভালো কোনো যুক্তি দিতে পারবো?  আমরা কি কোনো প্রকার যুক্তি তর্কের মাধ্যমে আমাদের অস্তিত্ব, বাহ্যিক জগতের অস্তিত্ব, অতীতের অস্তিত্ব, গাণিতিক সত্যতা এগুলো বিশ্বাস করি? অবশ্যই না! কারণ আমরা কখনোই যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করতে পারবো না যে, এই বাহ্যিক জগৎ আসলেই বাস্তবে অস্তিত্বশীল এবং কোনো বিভ্রম নয়, অতীতে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো আসলেই বাস্তব, ২+৩= ৫ই হতে হবে ৪ হবেনা, আমাদের যৌক্তিক অনুষদগুলো ভ্রান্ত নয়, ইত্যাদি। কোনো প্রকার যুক্তি ছাড়াই আমরা এগুলো বিশ্বাস করি কারণ এগুলো স্বতঃসিদ্ধ বা স্ব-প্রমাণিত। তাই আমরা নিশ্চিত যে আমরা নিশ্চিতভাবে এগুলো সম্পর্কে জানি।

সুতরাং, স্বতঃসিদ্ধ বা স্ব-প্রমাণিত বিশ্বাসগুলো যুক্তি ছাড়াই যদি স্বজ্ঞাত তাহলে স্রষ্টার বিশ্বাস স্বতঃসিদ্ধ হওয়ার পরেও কেন যুক্তি-প্রমাণ পাওয়ার পরেই তা জ্ঞানে পরিণত হতে হবে? আমরা মোটেও এমনটা বলছি না যে, স্রষ্টার অস্তিত্বের পক্ষে আমাদের কাছে কোনো ভালো যুক্তি নেই। স্রষ্টার বিশ্বাসের পক্ষে আমাদের কাছে অনেক ভালো যুক্তি রয়েছে। আমরা কেবল বুঝানোর চেষ্টা করছি যে, এমন অনেক কিছুই রয়েছে যা আমরা যুক্তি ছাড়াই বিশ্বাস করি যা স্বতঃসিদ্ধ বা স্ব-প্রমাণিত। ‘স্রষ্টা; স্বতঃসিদ্ধ সত্য’ অংশে আমরা ইতিমধ্যে প্রমাণ করেছি স্রষ্টার অস্তিত্ব স্বতঃসিদ্ধ বা স্ব-প্রমাণিত।

যাইহোক, নাস্তিকদের দাবি হলো কোন প্রস্তাব বা দবি ঠিক তখন জ্ঞানে পরিণত হবে যখন প্রস্তাবটি ন্যায়সংগত সত্য বিশ্বাস হবে। তার মানে যদি কোন প্রস্তাব ন্যায়সংগত সত্য বিশ্বাস হয় তাহলে প্রস্তাবটি সত্য বলে বিবেচিত হবে। কিন্তু, শুধু মাত্র ন্যায়সংগত সত্য বিশ্বাস হলেই কি একটি প্রস্তাবকে সত্য বলা যায়?

জ্ঞানের ত্রিপক্ষীয় বিশ্লেষণ

জ্ঞানতত্ত্বের ঐতিহ্যগত দৃষ্টিভঙ্গি হল যে কোন প্রস্তাবকে তখনই জ্ঞান দাবি করা যেতে পারে যখন সেই প্রস্তাবটি বিশ্বাসের জন্য আমাদের কাছে পর্যাপ্ত ন্যায্যতা থাকে, অন্য কথায়, জ্ঞান হল ন্যায্য সত্য বিশ্বাস।[1] James Ladyman; understanding philosophy of science; Page: 6 

যদি কেউ কোনো বিষয় উপস্থাপন করে বা প্রস্তাব করে তবে তাকে অবশ্যই তিনটি বিষয়ের আলোকেই উপস্থাপন করতে হবে। যেমন; ১. তাকে প্রস্তাবটি বিশ্বাস করতে হবে। ২. প্রস্তাবটি সত্য হতে হবে। ৩. প্রস্তাবটি ন্যায়সংগত হতে হবে। যেমন;

১. করিম একজন ভালো ছেলে।

২. মিস্টার রহিম বিশ্বাস করে করিম একজন ভালো ছেলে।

৩. সুতরাং মিস্টার রহিমের বিশ্বাস ন্যায়সংগত।

আপনি বিশ্বাস করেন যে ইউরোপের সকল হাতির রং গোলাপি। আপনার এই বিশ্বাস কি জ্ঞান হওয়ার জন্য যথেষ্ট? আপনার এই বিশ্বাসে জ্ঞান হওয়ার জন্য যে যে উপাদান রয়েছে তার সুস্পষ্ট একটি উপাদানের ঘাটতি রয়েছে। যেমন, সত্য। হাতি সম্পর্কে আপনার এই নিছক বিশ্বাস জ্ঞানের জন্য যথেষ্ট হবে না, যদি না আপনার বিশ্বাসটিও সত্য হয়। অর্থাৎ, যদি ইউরোপের সকল হাতি সত্যিকার অর্থেই গোলাপি হয় তাহলে আপনার বিশ্বাসটিও সত্য বলে বিবেচিত হবে। জ্ঞানের ত্রিপক্ষীয় বিশ্লেষণ আমাদের এটাই বলে।

একমাত্র সত্যই কি জ্ঞান হওয়ার জন্য যথেষ্ট?

জ্ঞানের ত্রিপক্ষীয় বিশ্লেষণ অনুযায়ী কোন প্রস্তাব জ্ঞান হতে হলে অবশ্যই, সেই প্রস্তাবটিকে বিশ্বাস করতে হবে, বিশ্বাসটি সত্য হতে হবে, এবং সেই প্রস্তাবের ন্যায্যতা থাকতে হবে। এখন একটি দৃশ্যপট কল্পনা করুন। ২০১৬ সালে যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হচ্ছিলো, তখন বাংলাদেশের অনেকেই বলেছিলো হিলারি ক্লিনটন বিজয় হবেন। কিন্তু নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর দেখা গেলে হিলারি ক্লিনটন পরাজিত হয়েছে। যারা এমন প্রস্তাব করেছিল যে হিলারি ক্লিনটন বিজয় হবে তাদের এই প্রস্তাবটি কি আসলে ‘জ্ঞান’ হতে পারে? অবশ্যই না! কারণ তাদের প্রস্তাবটি সত্য নয় এবং প্রস্তাবটির পক্ষে কোন ন্যায্যতাও ছিল না। দৃশ্যপটি এবার পুরোপুরি উল্টোভাবে চিন্তা করুন। নির্বাচনের অধিকাংশ মানুষ যদিও প্রস্তাব করেছিলো হিলারি ক্লিনটন বিজয় হবে তবে কিছু মানুষ প্রস্তাব করেছিলো হিলারি ক্লিনটন পরাজিত হবেন। নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করার পর দেখা গেল হিলারি ক্লিনটন পরাজিত হয়েছে! যারা এমন প্রস্তাব করেছিলো যে, ‘হিলারি ক্লিনটন নির্বাচনে পরাজিত হবে’ তাদের সেই প্রস্তাবটি কি জ্ঞান হতে পারে? উত্তর হচ্ছে, না। কারণ এখানে তাদের বিশ্বাস কাকতালীয় কারণে সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। এই বিশ্বাসের পক্ষে তাদের কাছে কোনো যুক্তি প্রমাণ বা ন্যায্যতা ছিল না। তবুও প্রস্তাবটি সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে।

আরেকটি দৃশ্যপট কল্পনা করুন। আপনি বিশ্বাস করেন যে বাহিরে আজ বৃষ্টি হচ্ছে। অ্যামেরিকার নির্বাচন সম্পর্কে আপনার যে বিশ্বাস ছিলো তার স্বপক্ষে আপনার কাছে কোনো প্রমাণ বা ন্যায্যতা না থাকলেও এই বিশ্বাস সম্পর্কে আপনার কাছে যুক্তি ও ন্যায্যতা রয়েছে। অর্থাৎ, আপনি আপনার বিশ্বাস এবং প্রমাণকে একত্রে সংযুক্ত করে একটি নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। আপনার ন্যায্যতা এই যে জানালার বাহিরে আপনি দেখতে পাচ্ছেন বৃষ্টি হচ্ছে। এই ক্ষেত্রে আপনি আপনার বিশ্বাসকে জ্ঞানে পরিণত করার উপাদানগুলো খুঁজে পেয়েছেন। যেমন, বিশ্বাস, সত্য এবং ন্যায্যতা।

ন্যায়সংগত সত্য বিশ্বাসই কি জ্ঞান হওয়ার জন্য যথেষ্ট?

‘ন্যায়সংগত-সত্য-বিশ্বাস’ জ্ঞান হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। ‘Gettier Problem’ দ্বারা এটি সহজেই ব্যাখ্যা করা যায়।

Gettier Problem

মনে করুন, আপনি সবেমাত্র আপনার স্থানীয় ডাক্তারের ওয়েটিং রুমে প্রবেশ করেছেন। আপনি খুবই চিন্তিত যে আপনি হয়তো আপনার সিরিয়াল মিস করেছেন। রাস্তায় এক দুর্ঘটনার কারণে আপনার হাতের ঘড়িটি হারিয়ে গিয়েছে তাই সময় সম্পর্কে আপনি অবগত ছিলেন না। ওয়েটিং রুমে বসে আপনি দেওয়ালে টাঙানো ঘড়ির দিকে লক্ষ করে দেখলেন এখনো বারোটা বাজে কেবল। স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন কারণ আপনার সিরিয়াল আসতে এখনো পনেরো মিনিট বাকি। আপনি সময় দেখে বিশ্বাস করে নিলেন এখনো ঠিক বারোটা বেজেছে মাত্র। এক্ষেত্রে আপনার জ্ঞানটি ন্যায়ঙ্গত-সত্য-বিশ্বাস।

এই ঘটনাটি ঠিক উল্টোভাবে চিন্তা করুন। আপনি ডাক্তারের ওয়েটিং রুমে প্রবেশ করলেন এবং খুবই চিন্তিত কারণ আপনার মনে হচ্ছে আপনি সিরিয়াল মিস করেছেন। কিন্তু আপনার একটা বিশ্বাস ছিল যে এই মুহূর্তে ঘড়িতে ঠিক বারোটা বাজে। আপনার এই বিশ্বাসটি আসলেই সত্য। এবং এর পক্ষে ন্যায্যতা ছিল যে, আপনি যখন দেওয়ালে টাঙানো ঘড়ির দিকে লক্ষ্য করে দেখলেন গড়িতে ঠিক বারোটাই বাজে। কিন্তু দেওয়ালে টাঙানো গড়িটা আসলে নষ্ট ছিল এবং আপনি যখনই গড়িটিকে পর্যবেক্ষণ করেছেন তখন উভয় কাটা বারোটার দিকেই ছিল। এই অকেজো গড়ি দেখে আপনার কি সত্য জ্ঞান অর্জন হয়েছে? উত্তর হচ্ছে, না! কেননা, আপনার কাছে ন্যায্যতা থাকার পরেও আপনার সত্য জ্ঞানের অভাব ছিল।

আরেকটু সহজভাবে বলি। মনে করুন একজন লোক মরুভূমিতে মরীচিকা দেখে ভাবলো সেখানে পানি আছে এবং সে সেখানে গিয়ে দেখলো যে সত্যিই সেখানে পানি আছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে মরীচিকা দেখেই পানি মনে করেছে। এখন এই কাকতালীয় ঘটনাকে ঐ ব্যক্তির জ্ঞান বলা যাবে না। কারণ ঐ ব্যক্তির কাছে ন্যায্যতা থাকলেও সত্য জ্ঞানের অভাব ছিলো।

আমরা ইতোমধ্যেই দেখেছি যে এমন অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ বিশ্বাস আমরা ধারণ করি যার জন্য কোন যৌক্তিক ভিত্তি নেই। যেমন, আমাদের মন, অতীত, বাহ্যিক জগতের অস্তিত্ব, ইত্যাদি। যুক্তির মাধ্যমে এই বিশ্বাস গুলো আমরা জানতে না পারলেও তবুও আমরা এগুলো সম্পর্কে নিশ্চিত। উপরে বৃষ্টি সম্পর্কে আমরা যে বিশ্বাসটি কল্পনা করেছিলাম তা আবার স্মরণ করুন। বাহিরে বৃষ্টি হচ্ছে এবং এই বিষয় সম্পর্কে আপনি নিশ্চিত হয়েছেন আপনার কগনেটিভ ফ্যাকাল্টি, দৃষ্টিশক্তি, এবং শ্রবণশক্তি দ্বারা। জানালার বাহিরে বৃষ্টির ফোঁটা দেখে আপনি নিশ্চিত যে এই মুহূর্তে বৃষ্টি হচ্ছে তা একেবারে স্পষ্ট। কারণ আপনি মনে করেন যে আপনি এই মুহূর্তে কোনো ভ্রান্তির মধ্যে নেই বা আপনার যৌক্তিক অনুষঙ্গ স্বাভাবিক রয়েছে। কিন্তু কিছু সময়ের জন্য চিন্তা করুন যে, আপনি হ্যালুসিনেশনে ভুগছিলেন এবং একটা মরুভূমিতে দেখতে ফেলেন যে এক জায়গায় পানি রয়েছে। কিন্তু আপনি কাছে গিয়ে দেখলেন সেখানে আসলে কোনো পানি নেই। সুতরাং, হ্যালুসিনেশন কারণে আপনি দেখা বিষয়টি জ্ঞান হচ্ছে না। কারণ আপনার বিশ্বাসটি সত্য ছিল না এবং এর পক্ষে কোনো ন্যায্যতা ছিল না।

সুতরাং, ‘Gatter Problem’ এর মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি যে JTB (সত্য-বিশ্বাসের সাথে মিলিত ন্যায্যতা) জ্ঞানের শর্ত প্রণয়নের একটি পর্যাপ্ত উপায় নয়। অনেকভাবে ‘Gatter Problem’ এর সমস্যা সমাধান করার চেষ্টা করা হয়েছে তবে প্রতিবারই তা ব্যর্থ হয়েছে। তাই ‘proper functionalism’ নামক থিসিস দাঁড় করানো হয় যার মাধ্যমে ‘Gatter Problem’ এর সমস্যা সমাধান করা। এই বিষয়ে যাওয়ার আগে আমাদের জ্ঞান এবং ন্যায্যতার মধ্যে পার্থক্য বুঝতে হবে। এ কারণে আমাদের ‘ওয়ারেন্ট’ সম্পর্কে জানতে হবে। ইতিমধ্যে আমরা দেখেছি জাস্টিফিকেশন জ্ঞানের শর্ত প্রণয়ন করতে ব্যর্থ। অতএব, আমরা ন্যায্যতা ব্যতীত অন্য একটি ধারণা সম্পর্কে কথা বলবো যা জ্ঞানের জন্য যথেষ্ট এবং এটিকে আমরা ‘ওয়ারেন্ট’ হিসাবে উল্লেখ করি। তবে এর মানে এই না যে ন্যায্যতাকে আমরা একেবারেই বাদ দিয়ে দিচ্ছি। ‘ওয়ারেন্ট’ বলতে বুঝানো হয় সেই বিশেষ সম্পত্তি যা সত্য বিশ্বাসকে জ্ঞানে পরিণত করে বা নিশ্চিত প্রমাণিত করে। অথবা এভাবেও বলা যেতে পারে যে, ওয়ারেন্ট হলো, যা জ্ঞান এবং নিছক সত্য বিশ্বাসের মধ্যে পার্থক্য করে। আমরা দেখেছি কেবল ন্যায্যতা আমাদের সত্য বিশ্বাসকে জ্ঞানে পরিণত করা বা নিশ্চিত প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট নয়। কিন্তু ‘ওয়ারেন্ট’ আমাদের সত্য বিশ্বাস এবং জ্ঞানে পরিণত হওয়ার মধ্যে যে ‘ফাঁক’ (Gap) থাকে তা পূরণ করে। তাই ওয়ারেন্ট হল সত্যিকারের বিশ্বাস এবং জ্ঞানের মধ্যে ‘শূন্যতা পূরণকারী’ (gap filler), এবং ওয়ারেন্টের মাধ্যমে আমাদের সত্য বিশ্বাস নিশ্চিতভাবে জ্ঞানে পরিণত হয়। যেমন,

S বিশ্বাস করে P অস্তিত্বশীল।

S-এর বিশ্বাস (P অস্তিত্বশীল) ওয়ারেন্টেড বা নিশ্চিত।

সুতরাং, P অস্তিত্বশীল।

একটি বিশ্বাস তখনই ‘ওয়ারেন্ট’ হবে যদি;

  1. It is produced by cognitive faculties functioning properly. (এটি জ্ঞানীয় অনুষদের দ্বারা উৎপাদিত হয় যা সঠিকভাবে কাজ করে)
  2. অর্থাৎ, আপনার জ্ঞানীয় অনুষদগুলি (দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি, ইত্যাদি) যথাযথভাবে কাজ করতে হবে। জ্ঞানীয় অনুষদগুলো কোন ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে না। যেমন, আপনি বিভ্রম কিংবা ডিলিউশনের কারণে যদি কোন জিনিস প্রতক্ষণ করেন তাহলে তা সত্য বা জ্ঞান বলে বিবেচিত হবে না। তাই আপনার জ্ঞানীয় অনুষদগুলো ভালোভাবে কাজ করতে হবে।
  3. In a cognitive environment sufficiently similar to that for which the faculties were designed. (একটি জ্ঞানীয় পরিবেশে যার জন্য অনুষদগুলি ডিজাইন করা হয়েছিল তার অনুরূপ।)

আমাদের জ্ঞানীয় অনুষদগুলো যেভাবে ডিজাইন করা হয়েছে তার অনুরূপ বা তার জন্য যথাযথ একটি পরিবেশ থাকা লাগবে যা আমাদের জ্ঞানীয় অনুষদগুলোর সাথে খাপ খায়। উদাহরণস্বরূপ, একটি গাড়ির চারটি চাকা রয়েছে, জ্বালানি তেল রয়েছে, এবং সব কিছু ঠিকঠাক মতো কাজ করে। এমতো অবস্থায় আপনি যদি গাড়িটিকে সাগরে ফেলে দেন তাহলে গাড়িটি সেখানে যথাযথভাবে কাজ করতে পারবে না। গাড়িটি সাগরে চলাচলের জন্য উপযুক্ত নয়। কারণ, গাড়িটিকে সাগরে চলাচলের মতো করে ডিজাইন করা হয়নি। একইভাবে আমাদের জ্ঞানীয় অনুষদগুলো যথাযথভাবে কাজ করার জন্য এমন একটি পরিবেশ প্রয়োজন যা জ্ঞানীয় অনুষদগুলোর সাথে খাপ খায়।

  1. Design plan aimed at the production of true beliefs. (জ্ঞানীয় অনুষদের পরিকল্পিত নকশার লক্ষ্য হবে সত্য বিশ্বাস উৎপাদন করা)

আমাদের জ্ঞানীয় অনুষদ এবং পরিবেশের একটি পরিকল্পিত নকশা থাকতে হবে যার লক্ষ্য হবে সত্য বিশ্বাস অর্জন করা, অবশ্যই মিথ্যা বিশ্বাস অর্জন করা নয়। আপনার জ্ঞানীয় অনুষদগুলো কীভাবে কাজ করবে তার অবশ্যই একটা নকশা রয়েছে। একজন আস্তিকের জন্য অবশ্যই ডিজাইনটি স্রষ্টা করেছে এবং একজন নাস্তিকের জন্য তা প্রকৃতি করেছে।

  1. Beliefs successfully being true. (বিশ্বাসটি সফলভাবে সত্য হবে)

আমাদের বিশ্বাসটিকে সফলভাবে সত্যে পর্যন্ত পৌঁছাতে হবে।

আমাদের বিশ্বাসে যদি উল্লিখিত ওয়ারেন্ট থাকে তাহলে বিশ্বাসটি অবশ্যই জ্ঞানে পরিণত হবে। কোন কিছু ওয়ারেন্টেড হতে হলে আমাদের জ্ঞানীয় অনুষদ সঠিকভাবে কাজ করতে হবে। যেমন, ধরুন আপনি একটি বাগানে কাঠ-বিড়ালি দেখতে পাচ্ছেন। এক্ষেত্রে আপনি বিভ্রমে ছিলেন বিধায় আপনি বাগানে কাঠ বিড়ালি দেখছেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সেখানে কোনো কাঠ বিড়ালি ছিল না। যেহেতু আপনি বিভ্রমে ছিলেন, আপনার জ্ঞানীয় অনুষদ গুলো ঠিকভাবে কাজ করছিলো না বিধায় আপনার এই দেখাকে (কাঠ বিড়ালি দেখা) জ্ঞান বলা যায় না। আবার মনে করুন, বাগানে আসলেই কাঠবিড়ালি ছিল। কিন্তু আপনি বিভ্রমে ছিলেন এবং আপনি কাঠ বিড়ালি দেখতেও পাচ্ছিলেন। এক্ষেত্রেও আপনার বিশ্বাস জ্ঞানে পরিণত হবেনা কারণ এবারও আপনি বিভ্রমে ছিলেন এবং আপনার জ্ঞানীয় অনুষদ সঠিকভাবে কাজ করেনি। সুতরাং, আপনার বিশ্বাস তখনই জ্ঞানে পরিণত হতে যখন একটা সত্য বিশ্বাসের সাথে ন্যয্যতা এবং ওয়ারেন্ট একই সাথে থাকবে। যখনই একটি বিশ্বাস একই সাথে ‘সত্য বিশ্বাসের সাথে ন্যায্যতা এবং ওয়ারেন্ট’ থাকবে তখনই বিশ্বাসটি জ্ঞানে ‘সঠিক কার্যকারণবাদ’ (proper functionalism) হিসেবে বিবেচিত হবে।

স্রষ্টার অস্তিত্বের প্রমাণ কি আসলেই আস্তিকদের দেওয়া লাগবে?

‘স্রষ্টা; স্বতঃসিদ্ধ’ অংশে ইতিমধ্যে প্রমাণ করেছি যে স্রষ্টার বিশ্বাস মানব মনের মৌলিক বা সহজাত বিশ্বাস। সহজাত বিশ্বাসগুলো ‘ওয়ারেন্টেড’ কারণ সহজাত বিশ্বাসগুলো স্বতঃসিদ্ধ, বা স্ব-প্রমাণিত, এবং নিশ্চিত। এ ধরনের বিষয়গুলো জ্ঞান হওয়ার জন্য কোনো কিছুর উপর নির্ভর করতে হয় না। বরং, তা স্বাধীন ভাবে জ্ঞানে পরিণত হয়। কোন বিশ্বাস নিশ্চিতভাবে সত্য হওয়া মানে বিশ্বাসটি ‘ওয়ারেন্টেড’। আমরা ইতিমধ্যে প্রমাণ করেছি যে, সহজাত বিশ্বাসগুলো নিশ্চিতভাবে সত্য। এগুলোকে কেউ অস্বীকার করতে পারে না। তাই অনিবার্যভাবে সহজাত বিশ্বাসগুলো ‘ওয়ারেন্টেড’। স্রষ্টার অস্তিত্বের বিশ্বাস সহজাত হওয়ার কারণে বিশ্বাসটি ‘ওয়ারেন্টেড’। যেহেতু, সহজাত বা ওয়ারেন্টেড বিষয়গুলো প্রমাণ করার জন্য কোন যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন করার প্রয়োজন নেই। সেহেতু, স্রষ্টার অস্তিত্বের পক্ষেও কোন যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন করার প্রয়োজন নেই। সুতরাং, বার্ডেন অফ প্রুফ বা প্রমাণের বোঝা আস্তিকদের উপর এ কথা মোটেই যুক্তিযুক্ত নয়। আমরা ইতিমধ্যে জেনেছি, স্বতঃসিদ্ধ বা সহজাত বিষয়গুলো যদি কেউ অস্বীকার করে তাহলে কেন সে এই বিষয়গুলো অস্বীকার করে সে দাবির স্ব-পক্ষে প্রমাণ উপস্থাপন করতে হবে। তাই কেউ যখন দাবি করবে সৃষ্টিকর্তা নেই তাকেই তার দাবির স্বপক্ষে প্রমাণ দিতে হবে।

এই বিষয়ে আরো একটি যুক্তি দেওয়া যায়, ধরুন আপনি একটি পজিশন ধারণ করেছেন যে, কোনো কিছু না দেখে বিশ্বাস করা যাবে না। সুতরাং, কোনো অতিপ্রাকৃতিক সত্তা রয়েছে এমন কিছু আপনি বিশ্বাস করেন না। তাই আপনি মনে করেন যারা অতিপ্রাকৃতিক সত্তার অস্তিত্বে বিশ্বাস করে তাদের এমন বিশ্বাসের পক্ষে প্রমাণ উপস্থাপন করতে হবে যে, কেন অতিপ্রাকৃতিক সত্তার অস্তিত্ব রয়েছে। আপনার এই ধারণাটি মোটেই সঠিক নয়। কারণ স্রষ্টার অস্তিত্বে অস্বীকারকারীকেও অস্বীকার করার পক্ষে প্রমাণ উপস্থাপন করতে হবে।

মনে করুন, আপনি ও আপনার বন্ধু একটা ক্রাইম স্পটে গেলেন যেখানে একজন নারীকে হত্যা করা হয়েছে। স্পটে ক্রাইমের অনেকগুলো আলামত পাওয়া গেল। যেমন; হত্যার জন্য ব্যবহার করা ছুরি, ভিক্টিমের গায়ে আঘাতের চিহ্ন, এক টুকরো চিরকুট, ইত্যাদি। আলামত গুলো দেখার পরে আপনি মনে করলেন যে এই নারীকে তার স্বামী হত্যা করেছে। একই আলামত দেখার পর আপনার বন্ধু আপনার মতের বিরোধিতা করে বললেন, এই হত্যা কিছুতেই তার স্বামী করতে পারে না, এটা করেছে তার বন্ধু। এই পরিস্থিতিতে আপনাকে প্রমাণ করতে হবে যে, কেন উক্ত নারীকে তার স্বামী হত্যা করেছে এবং আপনার বন্ধুকেও প্রমাণ করতে হবে যে, কেন উক্ত নারীকে তার স্বামী নয় বরং তার বন্ধু হত্যা করেছে। সুতরাং, এখানে প্রমাণের বোঝা কিন্তু উভয়ের উপরেই পরে। এবার মহাবিশ্বের সাথে এই উদাহরণটির তুলনা করুন। আমাদের এই মহাবিশ্ব অস্তিত্বের জন্য একটা শুরু রয়েছে, এটা ফাইন টিউনড, এর ভেতরের সব কিছু নির্ভরশীল। এসব আলামত থেকে একজন আস্তিক সিদ্ধান্ত নিলো যে মহাবিশ্বের অবশ্যই একজন সৃষ্টিকর্তা আছে। অন্যদিকে একই আলামতের উপর নির্ভর করে একজন নাস্তিক সিদ্ধান্ত নিলো যে সৃষ্টিকর্তা নেই। এক্ষেত্রে উভয় পক্ষকেই তাদের দাবির পক্ষে প্রমাণ উপস্থাপন করতে হবে। সুতরাং, প্রমাণের বোঝা কেবল আস্তিকদের কাঁদে এই দাবিটি মোটেও যুক্তিসংগত নয়।

Faith & Theology | Facebook

References

References
1 James Ladyman; understanding philosophy of science; Page: 6 

Sazzatul Mowla Shanto

As-salamu alaykum. I'm Sazzatul mowla Shanto. Try to learn and write about theology and philosophy.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button