আয়না ঘরঃ কুরআন তেলওয়াত করে তোর লাভ কি? তোর আল্লাহ কি তোরে বাঁচাইতে পারবো?

আয়না ঘরঃ কুরআন তেলওয়াত করে তোর লাভ কি? তোর আল্লাহ কি তোরে বাঁচাইতে পারবো?

সন্ধ্যার পর আমাদের সেলের সামনে যেই গার্ড থাকতো। সেই  কুলাঙ্গার একরাতে আমাকে এসে ডেকে বললো, উঠ যাওয়া লাগবে আমাদের সাথে। এটা বলেই জমটুপিটা পরিয়ে সেল থেকে বের করে উপরের দিকে নিয়ে যায় । তিনটা ফ্লোর হাটতে হয়েছে। ভিতরে নিয়েই চেয়ারের সাথে বেধে ফেলে। তারপর ওরা আমার চারপাশে বসে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসতে লাগলো। এবং সুন্দর করে বলতে লাগলো, 

তোরে কিন্তু ক্রস ফায়ার দেওয়ার কথা,  আমরা চাই না তোরে হারাইয়া তোর বোন আর মা অসহায় হইয়া পরুক। ( ইমোশনাল ব্ল্যাক মেইল করার চেষ্টা করছিল,যাতে আমি গলে গিয়ে তাদের ফাদে পা দেই) আমরা যা বলমু সেভাবে  তুই কিছু স্বীকারোক্তি দিবি, তাইলে আমরা অল্প কয়েকদিনের মধ্যে ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করবো। 

তখন আমি বললাম, আমি কোন মিথ্যা স্বীকারোক্তি দিতে পারবো না। সত্য হলে সেটা স্বীকার করতে হাজারবার প্রস্তুত। তারপর তারা আমার বাবা মাকে নিয়ে যেসব কথা বললো, আমি শুনে শুনে শুধু কাঁদতেছিলাম। সেদিন যেই পরিমাণ চোখের পানি ঝরছিল। সারাজীবনে কেঁদেও মনে হয় না এতো পানি ঝরছে। গায়ের পাঞ্জাবিটা ভিজে শেষ। অনেক কাকুতি মিনতি করলাম। তারপর চারপাশ থেকে বেধরক কিল গুশি মারা শুরু করলো!  

কু*** বাচ্চা বেশি সত্যবাদী হইছস? তোর সত্যবাদী দেখাইতেছি বলেই লাঠি দিয়ে পিটিয়ে হাত পায়ের হাড়গুলো গুড়া করে ফেলার মতো অবস্থা করেছিল। 

সেদিন হাত নাড়ানোর মতো শক্তিটাও ছিল না। রশি খুলে যখন সেলে নিয়ে যাবে তখন দাড়াচ্ছি না দেখে কান ধরে, দাড়ি টেনে বলছিল ভং না ধরে তাড়াতাড়ি দাঁড়া। আমাদের আরও কাজ আছে। তোরে দিয়ে আসা লাগবে। কেন দাঁড়াচ্ছি না আবারও মারা শুরু করলো ( আমি দাড়াতে পারছিলাম না)। এবার আমি চেয়ার থেকে পরে গেলাম। সেদিন কি হইছিল পরে আমি জানি না আর।

ঘুম ভাঙ্গার পর দেখি আমি সেলের মধ্যে। পুরা শরীরের যন্ত্রণায় কোঁকড়াচ্ছিলাম। গায়ে প্রচুর জ্বর। উঠে বসা তো দুরের কথা এপাশ ওপাশ করার শক্তিও নাই। অনেক কষ্টে ঘাড় ফিরিয়ে দেখি নিচের ফাঁকা দিয়ে  ৩-৪ লোকমা খাওয়ার মতো লাউ সবজি আর পঁচা ভাত দেওয়া। যার বাজে দুর্গন্ধ নাকে আসছিল। তখনই বমি করে দেই।

শরীরে শক্তি না থাকায় খাবার পর্যন্ত হাত নিতে পারিনি। প্রচুর জ্বর আর ব্যাথার তীব্রতায় ঘুমিয়ে গেছিলাম। দুপুরের খাবার দেওয়ার জন্য যখন বাটিগুলো নিতে আসছিল তখনও আমি ঘুমাচ্ছিলাম। সেই খাবারটাই দুপুরে খাওয়ার জন্য বললো। চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে ঘুম ভাঙ্গাইছে। কিন্তু বসার মতো শক্তি নাই। হাত পা ফুলে গেছে সব। আমি গার্ডকে চাচা আঙ্কেল বলে অনেক রিকুয়েষ্ট করছিলাম যে, আমাকে একটু ভালো পানি আর ওষুধ কিনে দেন। আমি মরে যাচ্ছি। এটা বলা মাত্রই,

জমিদারের বাচ্চা কয় কি! এখানে খাইতে আর ঘুমাইতে আইছস? গোলামের বাচ্চা আবার পানি ওষুধ চায়! 

আমি ; আঙ্কেল আমি ব্যাথায় মরে যাচ্ছি প্লিজ আঙ্কেল! একটু ব্যবস্থা করে দেন না। কোনোভাবেই তার মন গলানো গেল না। কই দেখি কি হইছে তোর! এসব বলে, যেখানে ফুলে গেছে সেসব জায়গা জোরে জোরে চাপ দিতে দিতে বললো, এসব ব্যাপার না। তুই ভালোই আছস বলে গেটে তালা দিয়ে চলে গেল। 

শীতকাল, ফ্লোরে পাতলা একটা ছেঁড়া ফাটা কম্বল, তার উপর কম্বলটা ভিজাইয়া দিয়ে গেছে। একদিকে পচা ভাতের গন্ধ আরেকপাশে বমি করা। ফ্লোরটা ভিজা। সেরাতে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে মনে মনে  আল্লাহর কাছে দোয়া করছিলাম, আল্লাহ আমাকে আজকেই তোমার কাছে নিয়ে যাও, নয়তো ইবরাহীম আঃ- কে যেভাবে নমরুদের আগুন থেকে নিজের কুদরতিতে রক্ষা করেছিলে সেভাবে তোমার কুদরতি শক্তিতে আমার কষ্টটা লাঘব করে দাও।চিৎকার করে কাঁদছিলাম আর আল্লাহকে ডাকিতেছিলাম।

দেখতে দেখতে রমজান মাস চলে আসলো। ভেবেছিলাম অন্যান্য দিন গুলোতে যা কিছু করতো না কেন রমজানে হয়তো কিছুটা মারধর, পঁচা নষ্ট খাবার থেকে রেহাই পাবো। ইন্ডাস্ট্রিয়াল এডজাস্ট ফ্যান অলওয়েজ চালু থাকতো, যাতে ভেতরের কোন আওয়াজ বাহিরে না যায় এবং বাহিরের কোন আওয়াজ ভেতরে না আসে। একরাতে ইলেক্ট্রিসিটির বিচ্ছিন্নতার কারণে নাকি কোন কাজের কারণে সেই ফ্যান প্রায় ১০-১৫ মিনিটের মতো অফ ছিল সিওর না। সময়টা শেষ রাতের দিকে, মসজিদের মাইক থেকে সাহরি খাওয়ার এলান হচ্ছে। বুঝলাম যে, রমজান মাস শুরু হয়ে গেছে। দেরি না করে সামহাও ওজু করে দুরাকাত তাহাজ্জুদ পরে আল্লাহর কাছে এই রমজানের উসিলায় জিন্দানখানা থেকে মুক্তির দোয়া করলাম। তারপর গার্ডকে সাহরি দেওয়ার জন্য ডাকলাম। সারারাত নেশারকরে মহিলাদের সাথে কলে নোংরা কথাবার্তা বলে তখন ঝিমাচ্ছিল। অনেকগুলো ডাক দেওয়ার পরও আসলো না। সেলের মধ্যে থাকা পানির বোতলটা নিক্ষেপ করলাম তার চেয়ারে। যাতে আওয়াজ শুনে তার ঘুম ভাঙে। কাজ হলোও। কিন্তু যে উদ্দেশ্য ডাকলাম, তার কিছুই হলোনা।

(ভালো খারাপ যে অবস্থায় থাকতাম না কেন! তেল মাড়িয়ে কথা বলতে হতো) আঙ্কেল! রোজা রাখবো, সাহরি খাওয়ার কিছু নাই।

কি বললি তুই? রোজা রাখবো তো! সাহরি খাওয়ার কিছু নেই! সাহরি লাগবে! 

মাতালের মতো আবোলতাবোল বকে চলে গেল। সাহরিও খাওয়া হলো না আর। রুচি না থাকাসত্বেও বাধ্য হয়ে সেলের মধ্যে থাকা কমোডের পাশে টেপ থেকে পানি খেয়ে রোজার নিয়ত করলাম। সকালের নির্ধারিত টাইমে নাস্তা দিয়ে গেল গন্ধযুক্ত বাটিতে করে। ২টা রুটি ছিল। না খেয়ে রেখে দিছি ইফতারে খাবো। নাস্তা দেওয়ার আনুমানিক দেড় দুই ঘন্টা পর কয়েকজন সেলের সামনে দিয়ে হাটাহাটি করছিল। ভেতর থেকে ডাকলে একজন আসে, তখন আমি একটা কুরআন শরীফ দেওয়ার কথা বলি। জিজ্ঞাসা করা হয় কোরআন দিয়ে করবি কি? আমি বললাম যে, রমজান মাস তো! তাই চাচ্ছিলাম  একটু কুরআন তেলাওয়াত করি।

কুরআন তেলোয়াত করে তোর লাভ কি?  তোর আল্লায় কি তোরে বাচাইতে পারবো?

বুঝাতে পারবো না ভেতরটা ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছিল তখন। পাল্টা রিএকশন দেখাই নাই। দেখালে আবারও মারবে। কিছু না বলেই চলে গেল। কিছুক্ষণ পর ২জন আমার সেলে আসলো। যাদের হাতে লাঠি। অতোটা বুঝতে পারিনি যে, ওরা আমাকে পেটাতে আসছে। গেট থেকে তালা খুলে ভেতরে আসলো। জিজ্ঞাসাবাদ শুরু,  

তুই নাকি রোজা রাখছস? সত্যি কইরা ক, কে তোরে এই খবর দিছে? তোরে কিছু করমু না। 

সহজ স্বীকারোক্তি দিলাম যে, এভাবে জানছি। কেউ এসে বলেনি। আমার কথা তাদের মনপুত হলো না। বাবা মা ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে বিশ্রীভাবে গালাগাল করা শুরু করলো, ওই ওরে এভাবে হইবো না, বাইর কর। সেল থেকে বের করেই আমাকে জমটুপি পরিয়ে গাড়িতে উঠালো। কেমন যেন মনে হচ্ছিল,  একই জায়গায় বারবার ঘুরিয়ে কাছের কোথাও নিয়ে গেল। ভিতরে নিয়ে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু, 

আ* **য়দা তা***বা** নের সাথে জড়িত কিনা? 

তাদের সাথে জড়িত কাউকে চিনে থাকলে নাম বলতে। তাহলে ছেড়ে দিবে। আদতে তাদের সম্পর্কে তখন আমার নূন্যতমও ধারণা ছিল না। আমি তাদেরকে চিনি না, তাদের সম্পর্কে জানি না বললে উরুর উপর লাঠি দিয়ে পেটানো শুরু হয়। অল্প কয়েকটা বাড়ি দেওয়ার পর আমার তৃষ্ণা লেগে যায়, পুরোদমে হাঁপাচ্ছিলাম। আবার জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হলো, 

রোজার ব্যাপারে কে তরে ইনফর্ম করছে? কুরআন দিয়া কি করবি? 

সব ঘটনা খুলে বললাম। মানতে নারাজ তারা। শুরু হয় পেটানো। এবার চেয়ার থেকে উঠিয়ে হাত পিঠ মোড়া করে বেধে লাথি, পেটানো শুরু হয়।খুব সম্ভবত রাবার জাতীয় কিছু বা কারেন্টের মোটা তার দিয়ে তাদের একজন পিঠে বাড়ি মেরেছিল। ফলে সেই জায়গা কেটে রক্ত বের হতে থাকে। প্রায় পুরা রমজান জুড়েই কোন কিছুর সাথে হেলান দিয়ে বসা, পিঠ নিচু করে ঘুমাইতে পারিনি। উপুড় হয়ে শুইতে শুইতে বুকের খাঁচা গুলো ব্যস্ততা হয়ে যেতো। যেই দাগ আমার ছোট্টবোন এখনো পর্যন্ত যতবার দেখেছে তাকে ততবার কান্না করতে দেখছি।

ওইদিন আর বেশি কিছু করেনি। গাড়িতে করে সেলে রেখে চলে যায়। এরপর থেকে আর কখনো সাহরি চাইনি। সাহরির জন্য রাতের খাবার আর আর দুপুরের খাবার দিয়ে ইফতার সারতাম।মাঝে মাঝে ভাগ্য ভালো থাকলে রুটি দিলে সেখান থেকে একটা দিয়ে সাহরি খেতাম আরেকটা দিয়ে ইফতার করতাম। ইফতার তুলনামূলক একটু দেরিতেই করতাম। কয়টা বাজে সেটা বুঝার কোন উপায় ছিল না। প্রতিবেলা খাবারের মধ্যে কি পরিমান গ্যাপ থাকে তার উপর ধারণা করে সবকিছু করতে হতো।

প্রায় তিন বা চারদিন পর আবারও কুরআন শরীফ চাইলাম। দেওয়া হলো না। পরেরদিন পুনরায় চাই, না দিলে চিল্লাফাল্লা করতে থাকি ভাবি হয়তো রাগ করে দিয়ে যাবে, এটা দিলে তাদের কিই আসে যায়! সেদিন হাত বেঁধে মুখে স্কচটেপ লাগিয়ে যায়। শ্বাস ফেলতে কষ্ট হচ্ছিল,চোখের নোনা পানি সেদিন সব মুখে ঢুকেছিল। নিয়ত করে ফেলি যতদিন না দিবে ততদিন আমি চাইতেই থাকবো। এভাবে ধুকে ধুকে মরার চাইতে তাদের জুলুম সহ্য না করতে পেরে হয় আল্লাহর কাছে চলে যাবো নয়তো মুক্তি পেয়ে বের হবো।

কয়েকদিন পর তাদের দিলে আল্লাহ একটু দয়া দিলেন। আমাকে একটা কুরআন শরীফ এনে দিয়ে গেল শুধু রমজানে পড়ার জন্য, আর সতর্ক করলো যদি উল্টা কিছু করতে দেখি তোর লা*শ কু**ত্তাকে খাওয়াবো। আমি চুপ থাকলাম।

দেখে দেখে কুরআন তেলাওয়াত করতে পারতাম। ছোট্ট ছোট্ট ৬টা সুরা মুখস্থ ছিল আগে থেকেই। কুরআন খতম করার সিদ্ধান্ত নেই। কয়েক পারা পড়ার পর হঠাৎ একদিন মুখস্থ করার চিন্তা আসে। সেদিন থেকে কুরআনের হাফেজ হওয়ার লক্ষ্যে পরা শুরু করি। আল্লাহর রহমতে রমজানের বাকী দিন গুলোতে ৪পারা মুখস্থ করে ফেলি। তখনও আমি জানতাম না যে, ঈদ শেষ হয়ে দুদিন পার হয়ে গেছে। আমার থেকে এসে কুরআন শরীফ নিয়ে গেল। সেদিনের খারাপ লাগাটা বলে বুঝানোর ভাষা আমার নেই। পায়ে ধরেছিলাম মারেন কা* টেন, কুরআন শরীফটা রেখে যান। নিয়েই গেল। সেই কয়টা দিন যখন কুরআনের একেকটা আয়াত পড়তাম হৃদয়ে কতটা প্রশান্ত অনুভব করতাম তা ব্যক্ত করতে গেলে একটা বই লেখা যাবে। সেই ৪পারার প্রতিটা পৃষ্ঠাতে কতো শত ফোটা চোখের পানি পরেছে, যার কারণে এক পৃষ্ঠার কালি অন্য পৃষ্ঠাতে ছেপে যেতো।  যতদিন কুরআনটা কাছে থাকতো ততক্ষণ কেমন যেন এক অলৌকিক প্রশান্তি পেতাম। 

ভিক্টিম তানভীর মাহতাব এর ফেইসবুক থেকে সংগৃহীত লিখা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button